কভিড সামলিয়ে উঠার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় বিপত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত। চলমান এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জোগান ব্যাপক আকারে কমেছে। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের আহারের পরিমাণে ভাটা পড়েছে। তবে খাদ্য সংকট মোকাবিলায় দেশীয় পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে এবং চাষযোগ্য জমিতে আবাদ করতে কৃষি খাতে আলাদা গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। একইসাথে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হচ্ছে। ২০২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে কৃষিঋণ বিতরণ হয়েছে মোট লক্ষ্যমাত্রার ৯৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য কৃষি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। তাতে প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) কৃষি খাতে ২৯ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯৫ শতাংশ। গত বছর একই সময়ে কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ২৫ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে এ ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ২ শতাংশ কৃষিঋণ হিসেবে বিতরণ করতে হয়। এর বাইরে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বিতরণ করা ঋণের পুরোটাই কৃষিঋণ হিসেবে বিতরণ করে। তাছাড়া ক্ষুদ্রঋণ বিতরণী সংস্থার (এনজিও) নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (এমআরএ) নিবন্ধিত এনজিও কৃষিঋণের বড় একটি অংশ বিতরণ করে। যেসব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পল্লী অঞ্চলে ঋণ বিতরণে যথেষ্ট অবকঠামো নেই, সেসব ব্যাংক এনজিওর মাধ্যমে বিতরণ করে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলো গত অর্থবছরের ১১ মাসে বিতরণ করেছে ১১ হাজার ৭৭৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। পুরো অর্থবছরে এসব ব্যাংকের ঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে এ খাতের ব্যাংকঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আবার ৪৮ দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক বিতরণ করেছে ১৭ হাজার ৫২১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। যদিও এসব ব্যাংকের ঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।

কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। করোনা মহামারি ও বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কৃষির গুরুত্ব ব্যাপকহারে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের মাধ্যমে সহায়তা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক সচেষ্ট রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো যদি এই খাতের প্রতি গুরুত্ব দেয় তবে খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা সহজ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিলো ২৮ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। তখন ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি বিতরণ করেছিলো। যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ১০২ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। যার মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসেই লক্ষ্যমাত্রার ৯৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো।

এদিকে নিজস্ব লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা ব্যাংকও রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম কৃষিঋণ বিতরণ করেছে মধুমতি ব্যাংক। ব্যাংকটি গত অর্থবছরের ১১ মাসে কৃষিঋণ বিতরণ করেছে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যা ৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। অন্যদিকে সর্বোচ্চ কৃষিঋণ বিতরণ করেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ বিতরণ করেছে ইসলামী ব্যাংক। বড় এই বেসরকারি ব্যাংকটির বিতরণ করা কৃষিঋণের পরিমাণ ২ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা।

গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কৃষি খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই তহবিলের আওতায় ধান চাষ, মৎস্য চাষ, কৃষি ও পল্লিঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচিতে উল্লিখিত শাকসবজি, ফল ও ফুল চাষ, প্রাণিসম্পদ খাতের আওতায় পোল্ট্রি ও দুগ্ধ উৎপাদন খাতে কৃষক পর্যায়ে ৪ শতাংশ সুদ হারে ঋণ বিতরণ করা হবে বলে জানানো হয়। তাছাড়া নীতিমালা শিথিল করে এক পরিবারের একাধিক ব্যক্তিকে ঋণ দেওয়ার বিধান করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকাররা বলছেন, কৃষিখাত দেশের অর্থনীতির গতি এখনো ধরে রেখেছে। কৃষিঋণ বিতরণের মাধ্যমে এখাতে উৎপাদন বাড়াতে পারলে দেশের খাদ্য সংকটের মাত্রা অনেকটা কমে আসবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথেষ্ট ভূমিকা পালন করছে। তবে ঋণ বিতরণের মাত্রাটা যদি একদম প্রান্তিক অঞ্চলে পৌঁছানো যায়, তাতে কৃষেকরা আরও ঋণ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হবেন। পাশাপাশি ঋণ বিতরণের মাত্রাও অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।

বিপি/আজাদ