ফরহাদ বিন নূর: এক ঘন্টা সময় কমিয়ে অনলাইনেই গ্রেডেড টার্ম ফাইনাল নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ বুয়েট প্রশাসন। পরীক্ষার মাত্র তিন সপ্তাহ আগে, তাড়াহুড়ো করে নেওয়া প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে হতবাক শিক্ষার্থীরা।
গত ২৮ জুলাই একাডেমিক কাউন্সিলের ৪৬৮ তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় সিদ্ধান্ত মোতাবেক গত ৩০ জুলাই শুক্রবার বুয়েটের ওয়েবসাইটে একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানুয়ারি ২০২১ টার্মের আসন্ন টার্ম ফাইনাল নিয়ে দিকনির্দেশনা ও নীতিমালা ঘোষণা করা হয়।

নোটিশের উল্লেখযোগ্য কিছু নীতিমালা নিন্মরূপ: LMS ও Virtual Meeting Software (Zoom, Microsoft Teams ও Moodle) এর মাধ্যমে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। শিক্ষার্থীদের গ্রেড নির্ধারণে Continuous Assessment ( Attendance, Class Test, Viva, Presentation) এর জন্য ৩০% নাম্বার এবং টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার জন্য ৭০% নাম্বার থাকবে। সকল কোর্স সমূহের জন্য টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার মোট সময়কাল হবে ২ ঘন্টা এবং পরীক্ষা শেষে উত্তরপত্র আপলোড করার জন্য সময় থাকবে ১৫ মিনিট। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক ভাবে দুইটি ডিভাইসের মাধ্যমে যুক্ত থাকতে হবে। একটি ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষা চলাকালীন খাতা ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্পূর্ণ দৃশ্যমান রাখতে হবে। অপর একটি ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র দেখা, উত্তরপত্র স্ক্যান ও আপলোডের কাজ করতে হবে।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

বুয়েট ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশের পর থেকেই অনলাইনে গ্রেডেড টার্ম নেয়ার এই নীতিমালাগুলো কতটুকু বাস্তবসম্মত ও ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে শঙ্কিত শিক্ষার্থীরা।

জানা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে বুয়েট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে (বিজ্ঞপ্তি নং:এসি/ অনলাইনশিক্ষাকার্যক্রম/স্নাতক/রে-৩২৬০(৮০) জানানো হয়, করোনা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে অনলাইনে ক্লাস শুরু করা হলেও টার্ম ফাইনাল অফলাইনে নেবার ব্যবস্থা করা হবে। প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হয়ে শিক্ষার্থীরা নতুন টার্ম শুরু করে। কিন্তু প্রকাশিত নোটিশ দেখে রীতিমত আশাহত হয়েছে শিক্ষার্থীরা।

অনলাইনে টার্ম ফাইনাল এক্সাম দেয়া বুয়েটের কিংবা বুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা নয়। কারণ, বিগত টার্ম জানুয়ারি ২০২০ এর টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাও অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু, বিগত টার্মের সঙ্গে চলতি টার্মের মূল পার্থক্য হলো চলতি টার্ম এ কোর্সগুলোয় গ্রেডিং দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যেখানে গত টার্ম ছিল আনগ্রেডেড (সন্তোষজনক/ ফেইল)।

ডিভাইস সমস্যা, ইন্টারনেট সমস্যা এবং সার্বিক অনলাইন শিক্ষাকাঠামোর উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন না এনে ছয়মাসের মধ্যেই অনলাইনে গ্রেডেড টার্ম ফাইনাল নেবার সিদ্ধান্তে অসন্তোষ শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, জানুয়ারি ২০২০ টার্মের আনগ্রেডেড ফাইনাল পরীক্ষায় আমাদের ভোগান্তির কথা ভেবে যেসব সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছিল, ২০২১ টার্মের বেলায় সেসব সুবিধা তো দেয়া হচ্ছেই না, বরং কিছু ক্ষেত্রে নীতিমালা আরো কঠোর হয়েছে। যেমন, আনগ্রেডেড টার্ম ফাইনালে যেখানে উত্তরপত্র সাবমিশনের জন্য ৩০ মিনিট সময় দেয়া হয়েছিল, এবারে সেই সময় কমিয়ে মাত্র ১৫ মিনিট নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত আনগ্রেডেড টার্ম ফাইনালে শিক্ষার্থীদের দিক বিবেচনা করে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষায় মোট গ্রেডের ৬০% বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু, এইবার, গ্রেডেড টার্ম ফাইনালে মোট গ্রেডের ৭০% বরাদ্দ রাখা হয়েছে, কিন্তু সময় বাড়ে নি। অর্থাৎ, কোর্সের ক্রেডিট আওয়ার যতই হোক না কেন, পরীক্ষার সময় হবে দু’ঘন্টা।

স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, অফলাইনে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাগুলোর সময়কাল ছিলো তিন ঘন্টা। উত্তর পত্র স্ক্যান করা কিংবা সাবমিশনের বাড়তি ঝামেলা ছিলনা যেহেতু সশরীরে উপস্থিত থেকে পরীক্ষা দিতে হতো। অথচ, অনলাইন পরীক্ষায়, যেখানে উত্তরপত্র লিখে, স্ক্যান করে তারপর সাবমিট করতে হয় এবং যেখানে নেটওয়ার্ক জনিত সমস্যা ও ডিভাইস ফেইলিউর এর ভয় থাকে, সেখানে পরীক্ষার সময়কাল বাড়বে এটাই আশানুরূপ। কিন্তু, সময় বাড়ানো তো দূরের কথা, উল্টো আরো ১ ঘন্টা সময় কমিয়ে পরীক্ষা নেবার সিদ্ধান্ত দিয়েছে প্রশাসন। যা কতটুকু বাস্তবসম্মত তা নিয়ে সন্দিহান শিক্ষার্থীরা।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বাণিজ্য প্রতিদিনকে বলেন, “তিন ক্রেডিট এর কোর্সে ২১০ নম্বর, ও চার ক্রেডিটের কোর্সে ২৮০ নম্বরের উত্তর করতে হবে মাত্র দু’ ঘন্টায়। এটি একটি গ্রেডেড টার্ম, কোনো ছেলেখেলা নয়। যেখানে অফলাইনে একই এক্সাম দেবার জন্য আমরা তিন ঘন্টা সময় পেতাম, সেই এক্সাম দু’ঘন্টায় শেষ করে ১৫ মিনিটের মাথায় উত্তরপত্র স্ক্যান করে সাবমিশন করতে হবে। কোনো ধরনের যান্ত্রিক গোলযোগ, নেটওয়ার্ক সমস্যা অথবা ডিভাইস ফেইলিউর হলেই হয়তো পিছিয়ে যেতে হবে এক টার্ম। এককথায়, অনলাইন টার্ম ফাইনালের মানসিক চাপ আমাকে বিভীষিকার মত তাড়া করে বেড়াচ্ছে।”

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সম্ভাব্য প্রতারণা এড়াতে পরীক্ষা চলাকালীন সার্বক্ষণিক ক্যামেরা অন রাখতে হবে এবং সার্বক্ষণিক পরীক্ষার খাতা ও পারিপার্শ্বিক ক্যামেরার মাধ্যমে দেখাতে হবে। কিন্তু একটি ল্যাপটপ ক্যামেরার মাধ্যমে একই সঙ্গে এত কিছু দেখানো কিভাবে সম্ভব তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি ওই নির্দেশনায়। এ নিয়ে এক শিক্ষার্থীরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের বক্তব্য হল- অনেক শিক্ষকই ক্যামেরা দিয়ে একইসাথে শিক্ষার্থীদের মুখ ও রাইটিং টেবিল দুটাই একসাথে দেখতে চান যেটা একটা ল্যাপটপের ক্যামেরা এঙ্গেল দিয়ে করা অসম্ভব। আর সেটা করতে হলে ল্যাপটপকে যেই এঙ্গেলে রাখতে হবে সেই অবস্থায় প্রশ্ন দেখা অসম্ভব।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন,”ক্যামেরার ইস্যু নিয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন ঝামেলায় পড়েছিল। ক্লাসটেস্ট চলাকালীন একজন শিক্ষকের কথা অনুযায়ী একসাথে চেহারা আর খাতা দুইটাই দেখাতে হবে ভিডিওতে। সেটা দেখাতে গিয়ে ল্যাপটপ এত দূরে রাখা লেগেছে যে প্রশ্নই আর দেখা যায়নি । আমি কখনো আশা করি নাই যে বুয়েট অফিশিয়ালি এই অযৌক্তিক জিনিসটা এখন এপ্লাই করবে টার্ম ফাইনালে।”

তাছাড়া, আগাম কোনো জরিপ কিংবা সবার কাছে প্রয়োজনীয় কর্মক্ষম ডিভাইস আছে কিনা জানার তোয়াক্কা না করেই দুইটি ডিভাইস দিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অথচ, যেসব শিক্ষার্থীদের দুইটি কর্মক্ষম স্মার্ট ডিভাইস নেই তাদের করণীয় সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রাখা হয়নি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি একেবারেই নিয়ন্ত্রণহীন। এই পরিস্থিতিতে, পরীক্ষা চলাকালীন কেউ কোভিড আক্রান্ত হলে কী করা হবে, এ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয় নি।

অবশ্য, ছাত্রকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিচালক (ডিএসডব্লিউ) প্রফেসর ড. মো. মিজানুর রহমান আশ্বাস দিয়েছেন যে উত্তরপত্র সাবমিশনের জন্য যে ১৫ মিনিট সময় দেবার কথা বলা হয়েছে তা পরবর্তীতে বর্ধিত করা হবে। তাছাড়াও, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন সহ পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে শিক্ষকদের নমনীয় থাকার ব্যাপারেও আশ্বস্ত করেছেন তিনি। কিন্তু, যেখানে অফিসিয়াল বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়ে গিয়েছে, সেখানে ছাত্রকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিচালক আশ্বাসের শুকনা কথায় আদৌ চিড়ে ভিজবে কিনা সেই আশঙ্কায় শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্ত ‘একরকম অবিচার’ মন্তব্য করে এক শিক্ষার্থী বলেন, সম্প্রতি মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক সম্পর্কে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ‘ওকলা’ কর্তৃক প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, ইন্টারনেটের গতির আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৭ টি দেশের মধ্যে ১৩৫ তম! এমনকি, ইন্টারনেটের গতির দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও আফগানিস্তান ছাড়া বাকি সবার পেছনে বাংলাদেশ। তাছাড়া, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও গ্রামগুলিতে ইন্টারনেট এখনো সহজলভ্য নয়। সুতরাং, অনলাইনে একটি গ্রেডেড টার্ম ফাইনাল আয়োজন করা হলে প্রত্যন্ত অঞ্চল ও গ্রামে বসবাসরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একরকম অবিচার করা হবে।

এইসব দিক বিবেচনা করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে প্রশাসন কে পরবর্তী টার্মের ক্লাস শুরু করে দেবার প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল। যাতে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ও শিক্ষার্থীদের ভ্যাক্সিনেশনের আওতায় আনার পর অফলাইনেই টার্ম ফাইনাল দেয়া যায়। তবে প্রশাসনের কাছে এই প্রস্তাব ধোপে টিকেনি।

করোনা মহামারীর এই প্রতিকূলতায় যেখানে শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের একটি বড় অংশ আক্রান্ত কিংবা আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে, সেই পরিস্থিতিতে প্রশাসন থেকে আরো শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্ত চায় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার কথা ভেবে ও মানবিক দিক থেকে টার্ম ফাইনাল নিয়ে ঘোষিত সিদ্ধান্ত গুলো পুনর্বিবেচনা করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, এমনটাই আশা শিক্ষার্থীদের।

এ বিষয়ে জানতে বুয়েটের উপাচার্য প্রফেসর সত্য প্রসাদ মজুমদারকে মুঠোফনে একাধিকবার কল করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।