১৯৪০ সালের আগ পর্যন্ত বিশাল আম বাগানটির মালিকানা ছিল ব্রিটিশ শাসনামলের ইংরেজদের। দেশভাগের পর ব্রিটিশরা বাগানটি তৎকালীন কানসাট এলাকার জমিদার হিসেবে পরিচিত কুজা রাজার কাছে বিক্রি করে দেন। বাগানটি কিছুদিন ভোগের পর কুজা রাজা তার সব সম্পদ ছেড়ে ভারতে চলে গেলে সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় রাজার সব সম্পত্তিসহ বিশাল এই বাগান। তখন থেকেই সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় কুজা রাজার বাগান নামে পরিচিত এই আম বাগানটি।

১৯৬৬ সালের দিকে বাগানটি পরিচর্যা ও দেখাশোনার দায়িত্ব পায় ঢাকার হর্টিকালচার। সেসময় বাগানে অনেক ছোট ছোট আম গাছ লাগানো হয়। তারা প্রায় ৫-৬ বছর থাকার পর বাগান ছেড়ে চলে যান। তখন থেকেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বাগানটি দেখাশোনা করে। কিন্তু জেলা প্রশাসনের সঠিক তদারকি না থাকায় ধ্বংস হতে থাকে বাগানটি। একের পর এক গাছ মারা যেতে থাকে। পরিত্যক্ত বাগানটি পরিনত হয় মাদকাসক্তদের আস্তানায়।

ঐতিহ্যবাহী বাগানটি রক্ষার জন্য উদ্যোগ নেয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন। শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটের এই বাগানকে ঘিরে নেয়া হয় নানা পরিকল্পনা। দেশে প্রথমবারের মতো আমের জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্মাণ করা হচ্ছে আমের জন্য মিউজিয়াম। নাম দেয়া হয়েছে “বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম।” বর্তমানে অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি বাগানটির গাছগুলো রক্ষায় পরিচর্যার কাজ চলছে। মাদকের আস্তানা ও অবৈধ বস্তি তুলে দিয়ে পুরো বাগানটি পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। জেলার তিনশ জাতের আমগাছ এ বাগানে ২০টি জোনে ভাগ করে সংরক্ষণ করা হবে।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

আমের রাজধানীখ্যাত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের সকল আমের জাতগুলো রক্ষায় জামপ্লাজম সেন্টারসহ তৈরিসহ নানা পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে দেয়া হয়েছে সীমানা প্রাচীর। জেলা প্রশাসন সম্প্রতি বেনামে থাকা জাতগুলোর ১০০ জাতের আমের নাম দিয়েছে। এসব জাত সংরক্ষণে নেয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরই শেষ হবে লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামের নির্মাণকাজ। ফলে এসব জাতের আমের বাজারমূল্য বৃদ্ধি পাবে। ম্যাংগো টুরিজম হিসেবে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে এই মিউজিয়ামের নাম।

বাগান ঘুরে দেখা, জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট মৌজার পার-কানসাট ও মোবারকপুর ইউনিয়নের শিকারপুর মৌজা মিলিয়ে প্রায় ৩২ একর ৯৮ শতাংশ বা প্রায় একশ বিঘা জমিতে ছোট বড় মিলিয়ে ৩ হাজার আম গাছের মধ্যে এখন রয়েছে প্রায় ২ হাজার আম গাছ। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের বেশ কিছু আম গাছ এখনও টিকে আছে। বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামে নির্মান করা হচ্ছে পিকনিট স্পট। নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে এখান থেকে বিভিন্ন জাতের আমের গাছ ও কলম সংগ্রহ করতে পারবেন কৃষকেরা। এছাড়াও কৃষকদের দেয়া হবে আমের চাষের জন্য প্রশিক্ষণ।

শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিডেটের সাধারণ সম্পাদক ও আম রফতানিকারক ইসমাঈল খান শামিম বলেন, আমচাষী ও রফতানিকারকদের দীর্ঘদিনের একটি দাবি ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের জন্য একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান নির্মাণের। ধন্যবাদ জেলা প্রশাসনকে এমন উদ্যোগ নেয়ার জন্য। আমরা জেনেছি, বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামে গত ২০০ বছরের নানা জাতের জামপ্লাজম সংরক্ষণ করা হবে। আধুনিক জামপ্লাজম সেন্টারের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে এসব জাতের আমের সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানায়।

তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রত্যাশা, বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম আম নিয়ে সামগ্রিকভাবে কাজ করবে। আমের গবেষণা, বাজারজাতকরণ, সম্প্রসারণ, রফতানিতে প্রক্রিয়াজাত করনসহ সকল কাজ করার দাবি জানায়। বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামকে ঘিরে এখানকার ম্যাংগো টুরিজম সম্প্রসারিত হবে। এই প্রতিষ্ঠান দেখে আশেপাশের আম বাগানীরা বাগান তৈরি করবে এবং দেশ-বিদেশের পর্যটকরা আম বাগান দেখতে আসবে।

আমচাষী রনি আহমেদ জানান, এখানে সকল জাতের আম সংরক্ষণ করা হবে। তাই স্থানীয় কৃষকরা খুব সহজেই এখান থেকে সায়ন সংগ্রহ করে বিভিন্ন জাতের আম নিজেদের আমবাগানে চাষাবাদ করতে পারবে। বাইরে থেকে মূল্য ও অধিক ঝুঁকি না নিয়ে আর চারা বা সায়ন সংগ্রহ করতে হবে না। এসময় বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বাগানে পরিচর্যার নানা কাজ করেন কানসাট ইউনিয়নের বাঁশমহল এলাকার আব্দুর রহিম (৫৫)। তিনি বলেন, ছোট থেকেই আমরা দেখছি বাগানটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। পরিচর্যা করার কোন লোকজন ছিল না। এরপর সম্প্রতি ইউএনও মহোদয় সীমানা প্রাচীর দেয়ার পর গাছগুলোর পরিচর্যা করতে শুরু করে। এখন গাছগুলোতে যাতে পোকার আক্রমণ না হয়, তাই স্প্রে করছি।

উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের চামাবাজার গ্রামের মাহফুজ আলম মিম। বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম থেকে তার বাড়ির দুরত্ব ৪-৫ কিলোমিটার। কয়েকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামের বিষয়ে জানতে পেরেছেন। এরপর সে আরও দুই বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে এসেছেন।

মাহফুজ আলম মিম বলেন, চমৎকার সুন্দর একটি জায়গা। বাগানটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। চাঁপাইনবাবগঞ্জকে বলা হয়ে থাকে, আমের রাজধানী। এই রাজধানীর একটি বিশাল পরিত্যক্ত বাগানকে যারা এতো সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে, তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানায়। এই মিউজিয়ামের মাধ্যমে দেশের মধ্যে ছাড়াও সারাবিশ্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে।

স্থানীয় আম ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম নামে যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছে, তাতে আমরা স্থানীয় আম ব্যবসায়ীরা অত্যান্ত আনন্দিত। কারন দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম পরিদর্শনে আসবে। আমরা জানি, একটি নিদিষ্ট এলাকা তখনই বেশি অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে পারে, যখন সেখানে বাইরে থেকে পর্যটকরা আসে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ব গবেষনা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সালেহ মো. ইউসুফ বলেন, সারাদেশের আমের জন্য এমন বিশেষ কোন প্রথম প্রতিষ্ঠান হলো বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম। পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জাতগুলোর সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। এমনকি হারিয়ে যাওয় জাতগুলোও সংরক্ষণ করা যাবে। জাত উন্নয়ন ছাড়াও আমের চাষাবাদ সম্পর্কে জানতে পারবে কৃষকরা।

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাকিব-আল-রাব্বী জানান, আমের জেলা হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এখানে নামিদামি আমের চেয়ে বেনামি ও অপরিচিত আমের সংখ্যাই বেশি। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এমন একশ জাতের আমের নাম দেয়া হয়েছে। এসব আমের মধ্যে এমন অনেক আম আছে, যেগুলো স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয়। নাম-পরিচয় বা প্রচার না থাকায় এসব আম বাজারে কদর পায় না। দামও পান না চাষিরা। ফলে অনেকেই গুটি জাতের এসব আম গাছ কেটে ফেলছেন। এতে অনেক সুস্বাদু আমও বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং বিলুপ্তির পথে আছে আরও অনেক আমের জাতও। আর নতুনভাবে নাম পাওয়া জাতগুলো সংরক্ষণ করা হবে এই মিউজিয়ামে।

তিনি আরও বলেন, আমকেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশে এবং সুস্বাদু আম রক্ষা ও জনপ্রিয় করতেই সরকারের ডেল্টা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেলার কানসাটে এ মিউজিয়ামটি গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। পাশাপাশি বাগানের একপাশে থাকবে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় কিছু স্পট। এমনকি জেলায় প্রত্যেক মৌসুমে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ আম নষ্ট হয়। এ থেকে রক্ষার উপায় জানতে পারবে স্থানীয় কৃষকরা। এছাড়াও রঙিন ও বিদেশি জাতের আমের জামপ্লাজম থাকবে, যা কৃষকেরা খুব সহজেই এখান থেকে নিতে পারবে। এতে লাভবান হবে স্থানীয় আমচাষী ও ব্যবসায়ীরা।

উল্লেখ্য, গতবছর ম্যাংগোপিডিয়া নামে ১০০টি প্রচলিত ও জনপ্রিয় আমের একটি প্রকাশনা অ্যালবামও প্রকাশ করেছে জেলা প্রশাসন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় ৮শ জাতের আম। এর মধ্যে আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জেই রয়েছে সাড়ে ৩শ জাতের আম।