ফান্ড সিকিউরিটিজ এবং ইনভেস্টরস সিকিউরিটিজের সমৃদ্ধি বৃদ্ধিতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তিন দিনব্যাপী সচেতনতামূলক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত সোমবার ডিএসই’র মাল্টিপারপাস হলে শুরু হওয়া এ কর্মশালা ট্রেকহোল্ডার কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারস, চেয়ারম্যান, পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের জন্য আয়োজিত হয়। বুধবার (২৫ জানুয়ারি) ডিএসই টাওয়ারে এ কর্মশালার সমাপনী ঘটে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিএসই’র চেয়ারম্যান মোঃ ইউনুসুর রহমান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএসইসি’র কমিশনার মোঃ আব্দুল হালিম।

অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে ডিএসই’র চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বলেন, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে এই সচেতনতামূলক কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। এই কর্মশালার বিষয়বস্তু অত্যন্ত সময়োপযোগী। সিকিউরিটিজ হাউজকে পরিচালনা করতে আইনকানুনগুলো কিভাবে প্রতিপালন করা যায়, সে বিষয়গুলো নিয়ে আজকের এই আলোচনা। পুঁজিবাজারে প্রচুর আইনকানুন হয়েছে। আইনকানুন ঠিকমতো পরিপালন না করলে পুঁজিবাজারে সুশাসন নিশ্চিত হবে না।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

তিনি বলেন, বিএসইসি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে বিভিন্ন আইন-কানুন, বিধি-বিধান প্রণয়ন করে থাকে। এই আইন-কানুন, বিধি বিধান পরিপালন আমাদের করতে হয়। পুঁজিবাজারের ইমেজ ট্রেকহোল্ডারদের উপর নির্ভর করে। কারণ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আপনাদের কাছে আসে। কমিশন এবং এক্সচেঞ্জের সাথে তাদের সরাসরি যোগাযোগ খুবই কম হয়। আপনারা যদি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বজায় রাখতে পারেন, তবে কমিশন এবং স্টক এক্সচেঞ্জ উভয়েই নিশ্চিত থাকতে পারে।

তিনি আরও বলেন, এখানে যারা উপস্থিত আছেন সকলেই আর্থিক খাতের লোক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরে আমরা অনেক উন্নতি করেছি। আর এ সময়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে আর্থিক খাত সম্পর্কে। আমাদের এগুলোকে কাটিয়ে উঠতে হবে। আমাদের পুঁজিবাজার ও বিমা খাত তুলনামূলকভাবে দূর্বল। আমাদের ব্যাংকিং খাত দূর্বল নয়। কিন্ত এটি বর্তমানে বিভিন্ন সমালোচনার মধ্যে রয়েছে। এগুলো থেকে উত্তরনের জন্য অনেক কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ সামাজিক উন্নয়নে এগিয়ে থাকলেও আর্থিক খাতে অনেক পিছিয়ে আছে। এই খাতের উন্নয়ন করতে না পারলে দেশের টেকসই উন্নয়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিগত এক বছরে অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। আমাদের বাজার মূলধন বেড়েছে, যা নিঃসন্দেহে উন্নয়নের নির্দেশক। কিন্ত সার্বিক পুঁজিবাজার নিয়ে গর্ব করার মত উচ্চতায় পৌঁছতে আরও সময় লাগবে। তাই আমাদের অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের পুঁজিবাজারের মূল উন্নয়ন ১৯৯০ সালের পর থেকে শুরু হয়েছে। এ সময়ে আমরা প্রচুর আইন-কানুন করেছি। সে জায়গায় কোন ঘাটতি নেই। বর্তমান কমিশন প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট, গুড গর্ভনেন্স এবং ব্রান্ডিং এর বিষয়ে কাজ করছে। আমরা আশাবাদি এই কমিশনের নেতৃত্বে পুঁজিবাজার সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আব্দুল হালিম বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখার মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে বৃহত্তর পরিসরে উপস্থাপন করাই হচ্ছে বিএসইসি’র লক্ষ্য। এই লক্ষ্যকে এগিয়ে নিতে পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য যে কোন ভাল পরামর্শকে বিএসইসি স্বাগত জানায়। পুঁজিবাজারের উন্নয়নের লক্ষ্যে যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণে আমরা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে চাই। কিন্ত ক্ষেত্র বিশেষ কঠোরও হতে হয়। যিনি অনিয়ম করবেন বা পুঁজিবাজারকে ক্ষতিগ্রস্থ করার চেষ্টা করবেন তারা শুধু নিজের ক্ষতিই করেন না, তাদের কারণে সমগ্র পুঁজিবাজারই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তারা কোনভাবে পুঁজিবাজারের বন্ধু হতে পারে না। তাদের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী যেটুকু কঠোর হওয়া প্রয়োজন কমিশন ততটুকু ভূমিকা পরিপালন করবে। তবে এ পথে আমরা আদৌ যেতে চাই না, আমরা বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে পুঁজিবাজার উন্নয়নকল্পে কাজ করে যেতে চাই। ট্রেকহোল্ডারদের অনেকে দেশে থাকেন না। তাঁদের বিশ্বস্ত কর্মচারীর মাধ্যমে তারা ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ফলশ্রুতিতে কিছু সমস্যা ও অনিয়ম দেখা দেয়। এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের স্টক এক্সচেঞ্জের কিছু ট্রেকহোল্ডার কোম্পানি দূর্বল অবস্থানে রয়েছে। বিএসইসিও চায় এসব পরিস্থিতি থেকে যাতে তাদের দ্রুত উত্তরণ ঘটে। আইনে যে মনিটরিং এবং এনফোর্সমেন্ট করতে বলা হয়েছে সেটা কমিশনের দায়িত্ব। আর কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে বলব যদি আপনারা সব কিছু সঠিকভাবে মেনে চলেন তবে কমপ্লায়েন্সের প্রয়োজন পড়বে না। যে রুলস, রেগুলেশনগুলো এসেছে, আমাদের উদ্দেশ্য হল কর্মশালার মাধ্যমে আপনাদের এই রুলস এবং রেগুলেশনগুলো জানানো যাতে আপনারা ভুলগুলো শোধরানোর মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেন এবং অবদান রাখতে পারেন।

পুঁজিবাজারে আপনাদের এই হাউজ অনেক পরিশ্রমের মাধ্যমে দাঁড় করানো হয়েছে, এখান থেকে লোকসান দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য নয়। আপনাদের বুদ্ধি, মেধা ও শ্রম দিয়ে পুঁজিবাজারে অবদান রাখার পাশাপাশি নিজেদের মুনাফাও সুনিশ্চিত করতে হবে। আর তাই আপনাদের নিজেদের কর্মকর্তাবৃন্দের প্রতি আরো নজর দিতে হবে। প্রত্যেক ব্রোকারেজ হাউজকে সেল্ফ কমপ্লায়েন্ট হতে হবে। বিএসইসি কর্তৃক প্রদত্ত আইন-কানুনের যথাযথ পরিপালন, কর্মকর্তাবৃন্দের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, অডিটেড রিপোর্ট জমা দেয়া ইত্যাদি কাজ সুষ্ঠভাবে পরিপালন করতে হবে। যাতে আইনের কোন ব্যতয় না ঘটে সেদিকে নজর দিতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে, আরও বড় হবে। জিডিপিতে পুঁজিবাজারের অবদান ২৩ শতাংশ। আমরা চাই এটা ১০০ শতাংশে উন্নতি করতে। অনাস্থার জায়গাটা দূর করতে চাই উল্লেখপূর্বক তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে ২০২৩ সালকে খুব চ্যালেঞ্জিং বছর হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। প্রত্যেক চ্যালেঞ্জের ভিতরেই অপরচুনিটি থাকে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই চ্যালেঞ্জকে অপরচুনিটিতে রূপান্তর করতে হবে।

মন্দাবাজারে মনিটরিং প্রসঙ্গে বিএসইসি’র কমিশনার বলেন, মনিটরিং এর ফলে যে সব হাউজ সামান্য ঘাটতিতে আছে তা নজরে আসে, এর ফলে এগুলো অতিক্রম করার সুযোগ পাওয়া যায়। এই সামান্য ঘাটতিগুলো যখন বড় আকার ধারণ করে তখন সেটা আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না, ফলশ্রুতিতে বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটে। আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাচ্ছি যাতে এসব সমস্যা থেকে উত্তোরণের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আপনারা অবদান রাখতে পারেন।

বিনিয়োগকারীদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থাকার ফলে রেগুলেটর হিসেবে বিএসইসি পুঁজিবাজারে স্বার্থ সংরক্ষনের জন্য ও বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে আইন প্রণয়ন করে থাকে। আপনাদের ব্যবসা কার্যক্রম সম্প্রসারনের জন্য ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখার জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন আমরা সব গ্রহণ করব। পাশাপাশি আপনাদের সহযোগিতাও কামনা করছি।

তিনি আরও বলেন, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়গুলো ট্রেক-হোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করছে তা আমাদের জানান। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার পাশাপাশি আপনাদের স্বার্থ যাতে সংরক্ষিত হয় সেই বিষয়টিও আমরা দেখব। প্রতিকূল পরিবেশের একটা ইতিবাচক দিক হলো অনেক ভালো ভালো উদ্ভাবনী বিষয়বস্তু এর মাধ্যমেই আসে। এই প্রতিকূল পরিবেশকে অতিক্রম করার জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তা কমিশন গ্রহণ করবে।

পরে ডিএসই’র মহাব্যবস্থাপক এবং কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আসাদুর রহমান, এফসিএস ‘স্ট্রেথিং দ্যা সিকিউরিটিজ অব ফান্ড অ্যান্ড সিকিউরিটিজ অব ইনভেস্টরস’ বিষয়ে পেপার উপস্থাপন করেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পরামর্শে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডকে বিনিয়োগকারীদের তহবিল এবং সিকিউরিটিজের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ডিএসই’র সকল ট্রেকহোল্ডার, কোম্পানির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালক এবং শেয়ারহোল্ডারদের জন্য বিনিয়োগকারীদের বৃহত্তর স্বার্থ এবং সিকিউরিটিজ বাজারের উন্নয়নের জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচির আয়োজন করেন।

এই সভার প্রধান উদ্দেশ্য হলো: ক্লায়েন্ট বা বিনিয়োগকারীদের তহবিল, সিকিউরিটিজ, সিকিউরিটিজ সংক্রান্ত আইনের পরিপালন এবং ট্রেকহোল্ডার কোম্পানির মালিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করা। তিনি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে বলেন, কোম্পানির কার্যক্রম স্থগিত করা, কোম্পানি এবং মালিকদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া, ট্রেকহোল্ডার কোম্পানির মালিকদের সামাজিক সম্মানের ক্ষতি, বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের ক্ষতি, সিকিউরিটিজ মার্কেটের উপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও বিশ্বাস হারানো, ট্রেকহোল্ডার কোম্পানি সম্পর্কে নেতিবাচক-প্রতিকূল চিত্র, সিকিউরিটিজ মার্কেটের উন্নয়নে বাধা এবং ট্রেকহোল্ডার কোম্পানির কর্মচারীদের সিসিএ থেকে নগদ উত্তোলন নিষিদ্ধ, মাসিক ভিত্তিতে সিসিএ মনিটর করা, মাসিক সিসিএ রিপোর্টের ভিত্তিতে সিসিএ-তে ঘাটতি পাওয়া গেলে কিছু শর্ত আরোপের নির্দেশনা জারি করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে ট্রেকহোল্ডার কোম্পানির চেয়ারম্যান, শেয়ারহোল্ডার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিইও এবং কমপ্লায়েন্স অফিসারের জন্য সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দিয়েছে। একই সাথে বাজারের মধ্যস্থতাকারীদের জন্য “স্বাধীনতা সুবর্ন জয়ন্তী পুরস্কার” চালু করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও ট্রেকহোল্ডার কোম্পানির পরিচালকগণের দায়িত্ব বা শেয়ারহোল্ডারদের দায়িত্ব এবং ডিএসই’র ট্রেকহোল্ডার কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারস, চেয়ারম্যান, পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকগণের বিনিয়োগকারীদের তহবিল এবং সিকিউরিটিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম, পরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম মজুমদার এবং অতিরিক্ত পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। সচেতনতামূলক এ কর্মশালায় পেপার উপস্থাপন করেন ডিএসই’র মহাব্যবস্থাপক এবং কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আসাদুর রহমান।