ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা আদিবাসী সম্প্রদায়ের নারী রায় মনি। সংসার সামলানোর পাশাপাশি দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন ফসলী জমিতে। গত কয়েকদিন আগেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের বিল কুজাইনে ধান কাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। পূনর্ভবা নদী দিয়ে ভারত থেকে আসা অতিরিক্ত পানিতে বিল কুজাইনসহ আশেপাশের প্রায় ৩ হাজার বিঘা জমির ধান প্লাবিত হওয়ার পর সেখানে দেখা দিয়েছে তীব্র শ্রমিক সংকট। ৩০০-৪০০ টাকার শ্রমিক এখন ১ হাজার টাকা করে দিতে হচ্ছে।

কিন্তু এরমধ্যেও দিনমজুরের কাজ করছেন না রাধানগর ইউনিয়নের শেখপাড়া গ্রামের হরিপদের স্ত্রী রায় মনি। বেছে নিয়েছেন তলিয়ে যাওয়া পানির নিচে ধান খোঁজার কাজ। বুক সমান পানিতে নেমে পা দিয়ে খুঁজছেন ধানের আঁটি। শুধু রায় মনি নয়, একই কাজ করছেন উরাঁও গোত্রের সরেস ধানুয়ার স্ত্রী হরোমনি তির্কী (৪০)। তবে শ্রমিক হিসেবে নয়, বরং কৃষকদের ধান খোঁজা শেষ হলে সেই জমিতে পা দিয়ে ধান খুঁজতে নামেন তারা।

রায় মনি বলেন, বিল কুজাইনে অনেকগুলো জমির ধান কাটার পর এখন পানির নিচে রয়েছে। কৃষক ও শ্রমিকরা তা পা দিয়ে খুঁজে বের করে ঘরে তুলছে। কিন্তু পা দিয়ে খোঁজার কারনে অনেক ধান জমিতেই থেকে যায়। তাই দিনমজুরের কাজ বাদ দিয়ে কৃষক-শ্রমিকরা খোঁজার পর তাদের জমিতে গিয়ে আমরাও একইভাবে খুঁজে বের করছি। কৃষকরা নিয়ে যাওয়ার পর আমরা যা পায়, তা সম্পূর্ণ আমাদেরই। এই ধান খুঁজতে গিয়ে অনেক জায়গায় বেশি গর্ত হলে ডুব দিয়ে ধান বের করছি৷

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

আদিবাসী নারী হরোমনি তির্কী জানান, মঙ্গলবার-বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গত তিন দিনে প্রায় সাড়ে ৪ মন ধান পেয়েছি। যেহেতু কৃষকেরা তাদের ধান নিয়ে চলে গেছে তাই আর কোন দাবি নেই তাদের। দিনমজুরের এমন সংকটেও শ্রমিকের কাজ না করে এমন কাজ করার কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বন্যার পানি আসার পর পুরুষ শ্রমিকদের বেতন ১ হাজার টাকা। কিন্তু সমান কাজ করে আমরা পাব ৫০০-৬০০ টাকা। দিনমজুর হিসেবে কাজ না করে তাই এভাবে ধান খোঁজার কাজই আমাদের জন্য ভালো। দৈনিক একেক জন এভাবে দেড় থেকে দুই মণ করে ধান পায়।

শুধুমাত্র রায় মনি বা হরোমনি তির্কী নয়, অনেক কৃষককেও একইভাবে ধান খুঁজতে দেখা গেছে। জশইল গ্রামের কৃষক সমিরুল ইসলাম বিল কুজাইনে ৮ বিঘা জমিতে বেরো ধান চাষাবাদ করেছিলেন। ধান কেটে আঁটি করে বেঁধে রাখার পরপরই অসময়ের বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় তার ধান। এমনকি তার কেটে রাখা ধানের উপরে জমা হয় বুক সমান পানি। এই কেটে রাখা ধান উঠানোর জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করেও শ্রমিক মিলছিল না।

বৃহস্পতিবার (১৯ মে) ১ হাজার টাকা করে ৪ জন শ্রমিক নিয়ে ধান উঠাতে এসেছিলেন সমিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৮ বিঘা ধান কেটে রাখার পরদিনই হঠাৎ পানিতে ধান তলিয়ে যায়। এখন শ্রমিক নিয়ে বুক সমান পানিতে এসব ধান পা দিয়ে খুঁজে খুঁজে উপরে তুলছি। অনেক ধানের আঁটি পায়ে বাঁধছে না। সেগুলো পানির নিচে থেকেই যাচ্ছে। পরে অনেক আদিবাসী নারী এসব ধান খুঁজে পাচ্ছে। শ্রমিকদের নিয়ে তাড়াহুড়ো করে উঠাতে হচ্ছে, কারন পানির স্রোত ও পানি বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

আক্কেলপুর গ্রামের কৃষক আবুল কালাম (৫০) ১৫ বিঘা জমিতে ধান চাষাবাদ করেছিলেন। বন্যার পানি আসার আগেই ৬ বিঘা জমির ধান ঘরে তুলতে পারলেও পানিতে তলিয়ে গেছে আরও ৯ বিঘা জমির ধান। আবুল কালাম জানান, বাকি ৯ বিঘার মধ্যে ৫ বিঘা কেটে রাখার পর পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সেই ধানগুলো শ্রমিকদের নিয়ে এখন মাজা সমান পানিতে হেঁটে হেঁটে খুজছি। কারন ইতোমধ্যে অনেক ধান পানির স্রোতে ভেসে গেছে। বাকি আরও ৪ বিঘা ধান জমিতেই লেগে ছিল।

শ্রমিক বারিউল ইসলাম বলেন, আমরা সাধারণত জমি থেকে ধান কেটে ঘরে তুলি। কিন্তু পানির নিচে কেটে রাখা ধান তলিয়ে যাওয়ার কারনে এখন এক বুক পানিতে নেমে সেই ধান খুঁজে বের করে উঁচু জায়গায় তুলতে হচ্ছে। কাজটা খুবই কঠিন। কারন পা দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে বের করে এরপর তুলতে হচ্ছে। এভাবে বৃহস্পতিবার সারাদিন ৮ জন শ্রমিক মিলে ৩ বিঘা জমির ধান তুলেছি। এমনকি খুঁজে পাওয়া ধানগুলো একসাথে বেঁধে পানিতে টেনে টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে।

গোমস্তাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ সরকার জানান, অন্যান্য বছরে ধান কেটে রাখার পর পানি আসলেও খুব কম সময়ের মধ্যে পানি চলে গেলে কৃষকরা আবার সেই ধান ঘরে তুলতে পেরেছে। তবে চলতি বছরে গত কয়েকদিনের পানির স্রোত তীব্র হচ্ছে এবং পানি বাড়ছে। এ থেকেই বোঝা যায়, এবছর অধিক পরিমানে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকেও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, কেটে রাখার পর তলিয়ে যাওয়া ধান যেভাবেই হোক ঘরে তুলতে হবে। তা না হলে এখন যা পাওয়া যাচ্ছে, পরে তাও না পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

উল্লেখ্য, বোরো মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৫০ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে ধান চাষাবাদ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে ৩ লাখ ৩০ হাজার ৫৮৫ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।