বাতাসে ঝনঝন শনশন মুড়ি ভাজার শব্দ। প্রতি বাড়িতেই মুড়ি ভাজার জন্য রয়েছে আলাদা ঘর। মুড়ি ভাজার কাজে নিয়োজিত বাড়ির মেয়েদের কেউ উঠানে ধান শুকাচ্ছে, মাঝে মাঝে সেই ধান নেড়ে দিচ্ছে, মাটির চুলায় চাল গরম করছে আর সেই চাল নারিকেলের খিল কিংবা পাটসোলা দিয়ে নাড়াচারা করছে। কেউবা সেই গরম চাল মাটির পাতিলে রাখা বালিতে পাটসোলা দিয়ে নাড়াচাড়া করছে। সেই চাল থেকে ফুটে যাচ্ছে মুড়ি।

নাটোরের গুরুদাসপুর পৌর সদরের খোয়ারপড়া, ধারাবারিষা ইউনিয়নের চরকাদাহ, খুবজীপুরের শ্রীপুর ও পিপলাসহ প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই মুড়ি তৈরি হতে দেখা যায়। কোন রাসায়নিক দ্রব্য ছাড়াই এখানে মুড়ি তৈরি হয় বলে দেশব্যাপি এ মুড়ির কদর রয়েছে। এই গ্রামের মুড়ি উৎপাদনকে কেন্দ্র করে পাশের সিরাজগঞ্জ জেলার হাটিকুমরুল মোড় এলাকায় গড়ে উঠেছে মুড়ির আড়ৎ। ওই আড়ৎ থেকে প্রায় প্রতিদিনই দুইশ মণ মুড়ি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়।

যাদের জমি আছে তারা মুড়ির ধান উৎপাদন করেন। আবার সেই ধান সিদ্ধ করে শুকিয়ে চাল তৈরি করে মুড়ি ভাজেন। রাসায়নিক সার ও কেমিকেলমুক্ত হওয়ায় এই মুড়ির ব্যাপক সুনামের পাশপাশি চাহিদাও রয়েছে। তাই নাটোরের গুরুদাসপুরসহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি জেলার মানুষের কাছে মুড়ির গ্রাম হিসাবে পরিচিত।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

এখানে বছরে যে পরিমাণ মুড়ি উৎপাদন হয় রমজান মাস এলেই তার দ্বিগুণ হয়। শুধু রমজান মাসই নয়, সারা বছর এখানকার মানুষের চাহিদা মেটায় এই গ্রামের মুড়ি। তাই দম ফেলার সুযোগ নেই এই কয়টি গ্রামের মানুষদের। আমন, বিনা-৭, হরি ধান, ২৯ ধান, ১৬ ধান, ৫২ ধানের মুড়ি উৎপাদিত হয় এখানে।

গ্রামে মুড়ি তৈরিতে নারীদের পাশাপাশি মুড়ি ভাজা থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছেন এখানকার পুরুষরা। ভোর থেকে ভাজা শুরু হওয়া এসব মুড়ি সকাল হলে নিয়ে যাওয়া হয় আড়ৎে। ভালো মুড়ি দিয়ে ইফতারের জন্য রমজান মাস শুরু প্রাক্কালে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই ছুটে আসছেন এই গ্রামে।

এরইমধ্যে এখান থেকে মুড়ি কিনে ঢাকা, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, সিরাজগঞ্জসহ দেশের নানান অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছে পাইকাররা। তবে এবার ধানের দাম বেশি হওয়ায় লাভ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মুড়ি উৎপাদনকারীরা।

স্থানীয় মুড়ি বিক্রেতা এবং দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারদের সমাগম ঘটে বাড়িতেই। নানা রকমের মুড়ি কেনাবেচা হয় বাড়ির ওপরেই। মুড়ির মান দেখে হয় দরদাম। তবে আমন ও হরি ধানের মুড়ির চাহিদা বেশি। আমন মুড়ি প্রতি মণ ২৮০০ থেকে ২৯০০ টাকা, ১৬ ধানের মুড়ি তিন হাজার টাকা থেকে ৩১০০ টাকা ও অন্যান্য মুড়ি গড়ে ২৫০০ থেকে ২৯০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন বাড়ির ওপরেই বিক্রি হয় এক থেকে দুই লাখ টাকার মুড়ি।

খোয়ারপাড়া মহল্লার মুড়ি উৎপাদনকারী মিলন হোসেন বলেন, শুধু মুড়ি কিনতে রমজান মাসেই অনেক মানুষ আসেন। তবে নানাস্থানে মেশিনে প্যাকেট করা মুড়ি তাদের এই হাতে ভাজা মুড়ির সুনাম নষ্ট করছে। পিপলা গ্রামের আব্দুল জব্বার বলেন, এই মুড়িতে কোনো রাসায়নিক সার দেয়া হয় না। লবণ আর বালু দিয়ে ভাজা হয় মুড়ি। তাই সারা বছর ধরে আমাদের মুড়ির চাহিদা বেশিই থাকে।

শ্রীপুর গ্রামের আছিয়া বেগম বলেন, এক মণ চালের মুড়ি ভাজলে ১০ থেকে ১২ কেজি মুড়ি তৈরি হয়। অন্য সময় আমরা রাত ১টা থেকে ২টার মধ্যে মুড়ি ভাজা শুরু করে পরদিন সকাল ৯টা ১০টা পর্যন্ত মুড়ি ভাজার কাজ করি। তবে রমজান মাসে আমরা প্রায় সারাদিনই মুড়ি ভাজি।

চাঁচকৈড় বাজারের মুড়ি ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বলেন, রোজার পাশাপাশি আম, কাঁঠালের মৌসুমে মুড়ির চাহিদা বাড়ে। স্বল্প পুঁজির এই ব্যবসা করে খুবজীপুরের শ্রীপুরসহ আশপাশের গ্রামের মানুষরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও স্থানীয় কোনো ব্যাংক এগিয়ে আসেনি তাদের পাশে। স্বল্প সুদে এসব মুড়ি উৎপাদনকারীদের ঋণ সহায়তা দিলে ব্যবসার পরিধি বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন মুড়ি উৎপাদনকারীরা। তাদের দাবি সরকার তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করলে তারা বেশী করে মুড়ি উৎপাদন করতে পারবেন।