করোনা মহামারির রেশ এখনো কাটেনি। মানুষ এমনিতেই বহুবিধ কষ্টে আছে। এর ওপর যোগ হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। আর দিন দশেক পরেই রহমত মাগফেরাত নাজাতের বার্তাবাহক পবিত্র রমজান মাস। মুসলমানদের কাছে রমজান তথা রোজার মাসের বিশেষত্ব অসীম।

বেশ কিছুদিন থেকে সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাগামহীন। মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। বিভিন্ন সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়ানোর কথাও বারবার উঠে এসেছে এসব প্রতিবেদনে। এত এত সংবাদের পরও সিন্ডিকেট যেন দিন দিন বটগাছে রূপ নিচ্ছে।

একদিকে সাধারণ ক্রেতামানুষের হা-হুতাশ বাড়ছে, অন্যদিকে লাভবান হচ্ছে শুধুই অসাধু সিন্ডিকেটগুলো। আওয়ামী লীগের সরকার যখন ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসে তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিছুটা হলেও সাধারণ মানুষের নাগালে রাখতে পেরেছিল। তাতে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্টও ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে সরকার গঠনের পর থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়া যে শুরু হয়েছে, তা যেন আর থামছেই না। বাজার মনিটরিং ঢিলেঢালা বা নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না। বিগত কয়েক বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চাল ডাল পেঁয়াজ রসুন তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম আগের চেয়ে বেড়ে দ্বিগুণ পর্যন্ত হয়েছে।

নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে দ্রব্যমূল্যের পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে সরকার গঠনের বছর দুয়েক পর থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। অথচ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরই আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মানুষের সাবলীল সুন্দর জীবনযাপনের জন্য। কিন্তু একটি অসাধু চক্র বারবার সরকারকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালায়। এই কাজে অসাধু চক্রটিকে অধিকাংশে সফলও বলা চলে। তাই সরকারের উচিত আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই চক্রটির মূলোৎপাটন করা।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, যেসব চিকন চালের দাম ২০০৯ সালে প্রতি কেজি ৩৫-৩৬ টাকা ছিল, ওই চালের দাম এখন দাঁড়িয়েছে ৫৭-৭৫ টাকা। মোটা চালের দাম ছিল ২২-২৩ টাকা, বর্তমানে ৫০-৫৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এক কেজি আটার দাম ছিল ২৭-২৯ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮-৪৬ টাকা। ময়দার কেজি ছিল ৩৫-৩৭ টাকা, বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০-৫৫ টাকা।

সয়াবিন তেলের দাম বর্তমানে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ২০০৯ সালে এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭০-৭৩ টাকা। বর্তমানে সেই তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭৫-১৮০ টাকায়। যদিও সরকার বলছে কেজি ১৬৮ টাকার উপরে যারা দাম নেবে সেসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এভাবে প্রায় সব পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে যাওয়া উপক্রম হয়েছে।

২০০৯ সালে গরুর মাংস কেজিপ্রতি দাম ছিল ২২০-২৩০ টাকা, বর্তমানে প্রতি কেজি (হাড়সহ মাংস) বিক্রি হচ্ছে ৬৫০-৭০০ টাকায়। আর হাড়ছাড়া প্রতি কেজি মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৮০০ টাকায়। গরুর মাংস এখন অঘোষিতভাবে অনেকটা উপরতলার মানুষের খাবার হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ এখন মেজবান কিংবা অনুষ্ঠানে গরুর মাংস খেতে পান।

তাছাড়া উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে শাক-সবজিসহ উৎপাদনশীল প্রতিটি পণের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। অথচ, উৎপাদনকারী কৃষক তাদের ন্যায্য মূল্য থেকে সর্বদা বঞ্চিত হয়। সেখানেও মধ্যস্বত্বভোগী অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তৎপর। এসব অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা তেমন চোখে পড়ে না। তার ওপর বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, গ্যাস বিল/ সিলিন্ডার খরচ, গাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা খরচ বিভিন্ন সেবা প্রাত্যহিক নানা খরচসহ জীবনযাপন সংশ্লিষ্ট সব খরচও বেড়েছে কয়েক গুণ।

আগে যেখানে ২০ হাজার টাকা বেতনের একজন চাকরিজীবী টেনেটুনে পুরো মাস সংসার চালাতে পারতেন, এখন সেই টাকায় মাসের অর্ধেক পার করা কঠিন হয়ে উঠেছে। এতে প্রতিনিয়ত সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। পারিবারিক কলহ বাড়ছে।

আর কিছুদিন পরই পবিত্র রমজান মাস। আরবসহ সারা বিশ্বে পবিত্র রমজান শরিফকে কেন্দ্র করে রোজাদারদের সম্মানার্থে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ৫০-৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেন। বিভিন্ন দেশে রোজাদারদের ইফতার সাহরি খাওয়ানো হয় বিনামূল্যে নেকির উদ্দেশ্যে। তার ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশে। অথচ বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। এ দেশে রমজান এলেই সবকিছুর দাম বেড়ে যায়।

এবার দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সরকার তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের জন্য ১ কোটি কার্ডের ব্যবস্থা করেছে। এই কার্ডের মাধ্যমে তারা সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি থেকে কম মূল্যে তেল, চিনি, ডাল, পেঁয়াজসহ কয়েকটি পণ্য ন্যায্য মূল্যে কিনতে পারবেন। তাতে অবশ্য ওই সব মানুষের সাময়িক কিছুটা স্বস্তি মিলবে। এ জন্য সরকার ধন্যবাদ পেতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের এই স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী করতে সরকারকে আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

অতি দ্রুত সিন্ডিকেটগুলো ভেঙে পণ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও মজুদদারি কঠোরভাবে দমন করতে হবে সারা দেশে। বাজার মনিটরিং জোরদার, অসম প্রতিযোগিতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, একক কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছে ব্যবসার বিশেষ সুবিধা আটকে না যাওয়া- এসব বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। কৃষক টু ভোক্তার একটি শক্তিশালী চেইন তৈরিতে উদ্যোগ গ্রহণ, অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়টি ভাবা যায়।

সবচেয়ে বড় বিষয়, সিন্ডিকেটে জড়িতদের লাইসেন্স বাতিল করে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে জেল জরিমানার বিধান নিশ্চিত করতে পারলেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগামে টান পড়বে বলে বিশ্বাস করি। আর তাতে জনমনে আসতে পারে স্বস্তি। অন্যথায় সাধারণ মানুষ নীরবে কান্না করেই যাবে।