কনিতা, রাবিতা ও বাসিতাহ্ ওরা সহোদর তিন বোন। পিতার মত ওরাও ভ্রমণ পিপাসু। মাঝে মধ্যেই সর্ট কিংবা লং ট্যুরে যেতেই হবে। বিশেষ করে রাবিতা কয়েকদিন যেতে না যেতেই ভ্রমণে যাওয়ার বায়না ধরে। আমিও তিন কন্যা বলতে অজ্ঞান। তাছাড়া এমনিতেই আমি শিশুদের একটু বেশিই ভালোবাসি। তাই ওদের আবদার আমি উপেক্ষা করতে পারি না। বর্তমান নগর জীবনে ঢাকার আকাশ উঁচু-উঁচু দালানে ঢেকে গেছে। চারপাশে ইট, কাঠ আর কংক্রিটের আস্তরণ, সবুজের দেখা মেলা ভার। বুকভরা নিঃশ্বাস, শিশু সুলভ দৌড়ঝাপ সেতো আজ কল্পনার রাজ্য। দু-চারটি পার্ক, উদ্যান যাও আছে তাও আবার বিকৃত মানুষের পদভারে পূর্ণ। যত টুকু সম্বল বারান্দার গ্রীল সেখানেও আবার বখাটেদের উৎপাত। তাই শিশুদের মানসিক বিকাশের স্বার্থে শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে ছুটে যেতে হয় দূরে কিংবা বহুদুরে। যেখানে কোমল প্রকৃতি তার আপন গৌরবে উজ্জল।
এবার ওদের বায়না ক্যাপ্টেন কক্স এর বিস্ময়কর ভৌগলিক প্রকৃতি কক্সবাজার। ইতিপূর্বে কনিতা, রাবিতা গিয়েছিল কিন্তু আড়াই বছরের বাসিতাহ্ এই প্রথম। তাই আর সবার চাইতে ওর উচ্ছাসের পরিমানটাও একটু বেশি। এবারের ট্যুরে শিশু থাকায় তাই দুই দিনের বদলে চার দিনের সময় সূচী নির্ধারণ করা হয়েছিল। দীর্ঘ বাস জার্নি শেষে দুপুর বারটা চল্লিশ মিনিটে গিয়ে পৌঁছালাম বক্সবাজারের কলাতলী ডলফিন মোড়ে। বাস থেকে নেমে সোজা হোটেলে। বীচে যাওয়ার জন্য শিশুদের যেন তর সহ্য হচ্ছিল না। দুপুরের লাঞ্চ শেষে একটু বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শিশুদের উচ্ছাসের কারনে তা আর হল না। বের হয়ে গেলাম দরিয়া নগরের পানে। স্বল্প দূরত্বের দরিয়া নগর পর্যটন কেন্দ্রে পৌছে জনপ্রতি বিশ টাকার টিকেট কিনে প্রবেশ করলাম। “দে-ছুটের” বন্ধুদের নিয়ে আমি এর আগেও এসেছিলাম। গাইড হল কিশোরী মেয়ে বিউটি, লাইফ পার্টনার কুলসুম ও আমার মেয়েদেরকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ব্রীফ সহ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। অন্ধকার গুহায় শিশুরা বেশ মজা পেল। তবে এবার কর্তৃপক্ষের উদাসিনতা লক্ষ করা গেল, আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিগণ দরিয়া নগর পর্যটন কেন্দ্রের সৌন্দর্য্য বর্ধনে আরো যত্নবান হবেন। প্রকৃতির দানকে পুঁজি করে শুধু বাণিজ্যিক চিন্তা ধারায় মগ্ন হলে সময় সুযোগ মত প্রকৃতিও বৈরী আচরণ করতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো এবার সোজা লাবনী বীচ পয়েন্টে। ছলাৎ, ছলাৎ ঢেউয়ের সাথে ওরা তিন বোনও লাফিয়ে উঠল। আমার তিন কন্যা যেন ঠিক এই মুহুর্তের জন্যই অধীর আগ্রহে ছিল। অনেকটা সময় মজা করে টুকিটাকি শপিং করে বার-বি-কিউ পর্ব শুরু হল। পরেরদিন সকালে সমুদ্রস্নান। কলাতলী বেলাভূমি তুলনা মূলক নিরিবিলি, তাপমাত্রা সহ্যের মধ্যে।কনিতার বায়না আব্বু তুমিও আমাদের সাথে সমুদ্রে নামবে। ওদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে নেমে পড়লাম নোনা জলে। কনিষ্ঠ শিশু বাসিতাহ্ সে কি আনন্দিত! বাসিতাহ্’র খিল খিল হাসি ভ্রমনের স্বার্থকতা বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘ সময় হৈ-হুল্লোড় করে ফিরলাম হোটেল লবিতে। আশ্চর্য বিষয় যাদের জন্য চার দিনের সময় নিয়ে এলাম, তাদের মাঝে মাশা-আল্লাহ কোন ক্লান্তির ছাপ নেই। লাঞ্চের পর কানা রাজার গুহা আর ইনানী ঘুরব। সবাই ঝটপট রেডি, হাস্যোজ্জ্বল ড্রাইভার রতনের মাইক্রোও রেডি। ভদ্র ছেলে তাই কক্স ভ্রমনে বরাবর ওকেই ডাকি। প্রথমেই পাটুয়ার টেকে কানা রাজার গুহার দিকে ছুটছি। আমারও প্রথম দেখা হবে। হিমছড়িতে খানিকটা সময় ব্রেক, কুলসুমের বায়না খোসা জড়ানো তেঁতুল আর পাহাড়ী বরই নিতে হবে। তেঁতুলের স্বাদ নিতে নিতে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পাটুয়ার টেক এসে পৌঁছলাম। যতটা উচ্ছ্বাস নিয়ে এসেছি তার চেয়ে বেশী বিমর্ষ হয়েছি প্রকৃতির দান কানা রাজার গুহা দেখে। রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে গুহার মুখ পাহাড় ধসে আটকে গেছে। আফসোস আমরা প্রকৃতির কৃপাকে সদ্বব্যবহার করতে জানিনা। পাটুয়ার টেকের সারিবদ্ধ সুপারি গাছ গুলো মনে অন্য রকম দোলা দেয়। গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা ইনানী বীচে। ততক্ষণে জোয়ার শুরু। যতখানি পাথর জেগে আছে সেখানেই পর্যটকদের ফটোসেশন। ইতিমধ্যে উচ্ছ্বাসের বাধ ভেঙ্গে রবিতার নীল জলে ডুব, সঙ্গে কনিতা ও বাসিতাহ্’র শৈবালের সাথে লুটোপুটি।
ভ্রমণে শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়, মানসিক উৎকর্ষতার পাশাপাশি শিশুকে দায়িত্বশীল হতে শেখায়। চার দেয়ালের বন্দীত্ব সোনামনির মনকে সংকীর্ণ করে তোলে। অবারিত সবুজ খোলা প্রান্তর শিশুকে প্রানবন্ত করে তোলে। যত্রতত্র নগরায়ণের সভ্যতায় হারিয়ে যাচ্ছে আজ সবুজ, নদী, খাল, হাওর, বাওড়। যতটুকু টিকে আছে তাও আবার বিষাক্ত। যেমন ঢাকার সৌন্দর্য বুড়িগঙ্গা নদী আজ প্রায় মৃত। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য যেন কারো কিছু করার নেই। সচেতনতার বড় অভাব। সবাই ছুটছি তো ছুটছি স্বীয় স্বার্থে। চারপাশে তাকানোর সুযোগ নেই। এমনকি কোমলমতি শিশুদের পাঠশালাও আজ বাণিজ্যিক। এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। যতটুকু সময় আছে তাতেই অনেক কিছু করা সম্ভব। প্রয়োজন একটু সুস্থ মানসিকতার। আসুন আমরা সবাই সম্মিলিত ভাবে সচেতন হই। গড়ে তুলি আগামীর প্রাকৃতিক প্রাচুর্যময় সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ। বাতাসে সীসামুক্ত বুক ভরা নিঃশ্বাস নিয়ে যেন বলতে পারে “আমার সোনার বাংলাদেশ আমি তোমায় ভালবাসি, ভালবাসি দেশকে মায়ের মত”। অনেক পিতা মাতাই আছেন তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত সুখের আশায় শুধু অর্থের পিছু ছুটছে। অথচ সন্তান একাকিত্বে ভুগে। অভিভাবকদের যথেষ্ট পরিমান সঙ্গ, আদর, সোহাগের অভাবে তাদের মেজাজ মর্জি বিগড়ে যাচ্ছে। বিষন্নতা এক সময় তাদের অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। ডুবে থাকে ভার্চুয়াল জগতে, হয়ে উঠে আত্মকেন্দ্রিক। ছোট্ট সোনামনিদের প্রতি অবিচার করার ফলে সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার জন্য আয় করা অর্থই অনর্থ হয়ে দাঁড়ায়। আসুন আমরা মাঝে মধ্যেই বাড়ির ছোট্ট সোনামনিদের নিয়ে ছুটে যাই দূরে বহুদুরে। যেথায় নয়ন জুড়ানো প্রকৃতি তাদের আপন করে নিবে। সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হতে অনুপ্রাণিত হবে। সন্তান ছেলে কিংবা মেয়ে যাই হোক সবাই যেন থাকে স্নেহ ধন্য হয়ে।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন