-ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা
-তিন মাসে বাড়ল ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা
-এক বছরে বেড়েছে ১৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা

করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। নীতিসুবিধার কারণে ওই সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করেও কেউ খেলাপি হননি। ২০২১ সালে কিস্তির ২৫ শতাংশ ঋণ পরিশোধে নিয়মিত থাকার সুযোগ দেয়। এই ছাড়ের কারণে একজন গ্রাহকের যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, তাও করেনি। এখন এই বিশেষ সুবিধা না থাকার কারণে ব্যাংক খাতে বেড়ে চলছে লাগামহীন খেলাপি ঋণের অংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২২ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। যা দাঁড়ায় মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০২১ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। যা শতাংশ হিসেবে ১৯ দশমিক ৩০।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

আর গত বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বাড়বেই। যতদিন না সরকার ঋণ ফেরাতে আন্তরিক হবে ততদিন দেশে খেলাপি কমবে না। এ দেশে ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংখ্যা বেশি। তাই বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়ার পরও কোনোভাবেই খেলাপি ঋণ কমানো যায়নি। এখন সেই সুবিধাগুলোও নেই। ব্যবসায়ীরা আবার সেই সুবিধা চেয়েছেন। এ সুবিধা দেয়া কোনভাবেই উচিৎ হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাণিজ্য প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংকগুলো ফরেন একচেঞ্জ, আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা আপাতত খেলাপি ঋণ আদায়ের বিষয়ে ভাবছে না। দৃষ্টিটা অন্যদিকে চলে গেছে। এর ফলে খেলাপি ঋণের অংক বেড়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত নজরদারি করা উচিত। তা না হলে অসুবিধায় পড়বে ব্যাংকিং খাত।

ব্যবসায়ীরা নতুন করে সুযোগ চাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছি, ঘুরে দাঁড়াবো এসব নিয়েই ব্যস্ত। হঠাৎ করে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলো। সবকিছু থমকে গেল। এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা আবার নতুন করে সুবিধা চাচ্ছে। এখন আর নতুন করে সুবিধা দেয়া উচিত হবে না। ব্যবসায়ীদের যথেষ্ট সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এটা এখানেই শেষ করা উচিত। নতুন বাজেটে এসব বিষয়ে ঘোষণা থাকা উচিত।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মার্চ শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৮ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা মোট ঋণের ২০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল ৪৪ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ।

বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৫৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৯ লাখ ৭০ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৫১ হাজার ৫২০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ।

বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা। যা এই অংক ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে মোট ৩৩ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের অংক ছিল ৩ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। যা এই অংক ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ০২ শতাংশ।

বিদেশি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৬৩ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকের দুই হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ২ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ঋণখেলাপির শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক। মার্চ শেষে ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ১৩ হাজার ১২৪ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ১০ শতাংশ খেলাপি। বেসরকারি ব্যাংকের টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ন্যাশনাল ব্যাংকের। এই ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা বা প্রায় ১৫ শতাংশ। বিদেশি খাতের সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের। তাদের মোট ঋণের প্রায় ৯৯ শতাংশ বা ১৩৭০ কোটি টাকাই খেলাপি। বিশেষায়িত ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি খেলাপি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা।