চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে নিয়োগকৃত ৪’শ ৬৯টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের ৩০ জুন।

এরপর তিন মাস অন্তর পুরোনোদের দফায় দফায় নিয়োগ দিয়ে ৮টি গোপন চিঠি ইস্যু করেছে সরকারের সংস্থাটি। ফের নতুনকরে সেই পুরোনো ঠিকাদারদের মেয়াদ বাড়িয়ে চিঠি ইস্যুর তোড়জোর চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। যদিও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ি দুই বছর অন্তর উম্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগের নিয়ম রয়েছে। তবে তা বিভিন্ন অযুহাতে উপেক্ষাকরে গোপন চিঠিতে সংঘবব্ধ সিণ্ডিকেটের মাধ্যমে খাদ্য পরিবহন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা।

এসব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা- কর্মচারি এবং তাদের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও বাবা-মা। আবার অনেকে শ্বশুর-শাশুড়ির ও শালা-শালী নামেও প্রতিষ্ঠান গড়ে ঠিকাদারী ব্যবসা করে যাচ্ছেন।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারি আর ক্ষমতাসীন দলের কিছু প্রভাবশালী ঠিকাদারকে ব্যানারে রেখে এখানে একটি সিণ্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিণ্ডিকেট গোপন আঁতাতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের খাদ্য পরিবহন খাতটিকে কব্জায় নিয়ে নতুন ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র আহবান (টেণ্ডার) বার বার আটকে দিচ্ছে। মূলত এদের কারণে বিগত ২৪ মাসেরও (দুই অর্থ বছরে) পিপিআর অনুযায়ি নতুন ঠিকাদার নিয়োগে কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। কবে নাগাদ চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর নিয়মে ফিরতে পারবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না।

খাদ্য বিভাগের তথ্যমতে, দেশে সরকারি ভাবে আমদানিকৃত খাদ্যশস্যের বেশির ভাগই আসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে প্রান্তিক কৃষক ও চালকল মালিকদের কাছ থেকেও খাদ্যশস্য ক্রয় করে সরকার। এসব খাদ্যশস্য সংরক্ষণে চট্টগ্রামের হালিশহর ও দেওয়ানহাটে রয়েছে কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদাম। একইভাবে গম মজুদে নগরের পতেঙ্গায় রয়েছে সাইলো।

পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর রেশনের চাল, গম এবং সরকারি খাদ্যবান্ধব প্রকল্পের খাদ্যসহায়তা চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার বিভিন্ন খাদ্যগুদামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিয়োগ করা হয় এসব ঠিকাদার। এজন্য দূরত্ব আর যোগাযোগব্যবস্থা বিবেচনা করে ঠিকাদারদের মাইলপ্রতি পরিবহন ভাড়া দেয় খাদ্য বিভাগ। প্রতিটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বছরে একাজে ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা বিল প্রদান করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ী এই ধরনের পরিবহন ঠিকাদার কাজের জন্য স্থানীয় খাদ্য বিভাগ থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। দূ’বছর পরপর প্রকাশ্য দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে কর্মদক্ষতা ও অন্যান্য শর্ত বিবেচনায় নতুন ঠিকাদার নিয়োগ এবং লাইসেন্স ইস্যুর বিধান আছে।

২০১৮ সালে ইস্যু করা ৪’শ ৬৯টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের জুনে। এরপর দূ’বছর গত হতে চলেছে নতুন কোনো ঠিকাদার নিয়োগের উদ্যোগ আর দেখা মিলেনি। আগে নিয়োগ দেওয়া বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স তিন মাস অন্তর সাময়িক নবায়ন দেখিয়ে খাদ্যশস্য পরিবহন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তাঁরা। এরআগে ২০১৪-২০১৫ ও ২০১৫-২০১৬ দুই অর্থ বছরের জন্য খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগ করা হলেও ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছর পর্যন্ত চার বছর দরপত্র আহবান আটকে রাখে এই সিণ্ডিকেট। পরে বিষয়টি সরকারের উচ্চ মহলে জানাজানি হওয়ায় সর্বশেষ ২০১৮-২০১৯ ও ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দরপত্রের মাধ্যমে পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগ দেয়।

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকার মোহাম্মদ আজাদ বলেন, চট্টগ্রাম হালিশহর কেন্দ্রীয় খাদ্য সরবরাহ কেন্দ্রের (হালিশহর সিএসডি) একাধিক কর্মকর্তার স্ত্রীসহ স্বজনদের অর্ন্তভুক্ত করার ব্যাপারে খাদ্য অধিদপ্তরে অভিযোগও আছে। তবে সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে একাধিক স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা খাদ্য বিভাগে ঠিকাদারী করছেন।

মোহাম্মদ আজাদের অভিযোগ, খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের কারণে নতুন কেউই এই সংস্থাটিতে ঠিকাদারীতে অর্ন্তভুক্তের সুযোগ পাচ্ছেন না। রাঙামাটির ব্যবসায়ী এমাদুল হক, খাগড়াছড়ির মো. সাইফুল ইসলাম ও বান্দরবানের ইসমাইল হাসানেরও একই ধরণের অভিযোগ।

খাদ্য পরিবহন ঠিকাদারদের একটি সূত্র জানায়, সরকারি খাদ্যবান্ধব প্রকল্পের চাহিদাপত্র অনুযায়ি (ডিও) চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১১টি জেলার বিভিন্ন খাদ্যগুদামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য চট্টগ্রামের সিএসডি ও সাইলো থেকে খাদ্যশস্য বের করা হলেও তা গন্তব্যে পৌছানো হয় না। খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পরিবহন ঠিকাদার ও স্থানীয় ডিও ব্যবসায়ীরা গোপন আঁতাতে তা চট্টগ্রাম নগরের কোনো গুদামে খালাস করে নেয়। তবে সংশ্লিষ্ট খাদ্যগুদামে পৌছানো হয় শুধুমাত্র ইনভয়েস বা চলাচল রশিদ। আর এর বিপরীতে সরকারের অযথা কোটি কোটি টাকা পরিবহন ভাড়া ব্যয় দেখিয়ে লুটে নেয় এই সিণ্ডিকেট।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. জহিরুল ইসলাম খান বলেন, করোনাকালিন মহামারীর কারণে অনেকদিন এসব নিয়ে কাজ করাই সম্ভব হয়নি। এখন দরপত্রের সৃষ্ট কিছু জটিলতা সমাধান করে যত দ্রুত পারা যায় দরপত্র আহবানের চেষ্টা চলছে। তবে কবে নাগাদ দরপত্র আহবান করা হবে, এই প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর মিলেনি চট্টগ্রামের এই আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের নিকট।

বিপি/এএস