সিলেট নগরের হাওলাদারপাড়া এলাকার একটি টিলার নাম জাগো টিলা। উঁচু এই টিলার একেবারে কিনারা ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে কয়েকটি ঘর। উপরের ঘরগুলোর ঠিক নিচে, টিলার পাদদেশেও ঘর রয়েছে কয়েকটি।

ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েকদিনের বৃষ্টিতে জাগোটিলার মাটি ধসে পড়ছে। শঙ্কা দেখা দিয়েছে বড় ধরনের ধসের। ফলে টিলার উপরে ও ঢালে বসবাস করা সবগুলো পরিবারের বাসিন্দারাই রয়েছেন উচ্চ ঝুঁকিতে। প্রাণের শঙ্কা নিয়েই বছরের পর বছর ধরে তারা বসবাস করে আসছেন এখানে।

সিলেটের জৈন্তাপুরে এরকম একটি টিলাই সোমবার ভোরে ধসে পড়ে ঢালে থাকা ঘরের উপর। এতে মারা যান ওই পরিবারের ৪ সদস্য। আহত হন আরও পাঁচজন। প্রতিবছরই বর্ষায় সিলেটে টিলা ধসে এরকম প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আহত আর ক্ষয়ক্ষতি হয় আরও অনেক। তবু টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের পুনর্বাসনে এখন পর্যন্ত কোন উদ্যোগ নেই। টিলার উপরে ও ঢালে কী পরিমাণ লোক ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে তার কোন তালিকাও নেই প্রশাসনের কাছে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে এমন ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে মাইকিংয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ। পুনর্বাসনের কোন
উদ্যোগ না থাকায় বাড়ছে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

যদিও ২০১২ সালে সিলেটের পাহাড় টিলা সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের এক রায়ে টিলার উপর ও পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেয়া হয়।

সোমবার জৈন্তাপুরের দুর্ঘটনার আগেই রোববার ভোরে ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়া এলাকার একটি টিলা ধসে ঢালের চারটি ঘরের উপর পড়ে। এতে কোনপ্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও ওই চারটি ঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তার আগে গত ১৪ মে গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষনাবন্দে টিলা ধসে মারা যান অপু লাল রায় নামে এক এনজিও কর্মী। লক্ষনাবন্দের চক্রবর্তী পাড়ার একটি টিলার পাদদেশেই ঘর ছিলো অপুদের। প্রতিবছরই টিলা ধসে এমন প্রাণহানি ঘটে সিলেটে।

নগরের হালদার পাড়ায় জাগোটিলার উপর ঘর বানিয়ে বাস করা শামসুল ইসলাম বলেন, এটি সরকারি টিলা। ভাড়া দিতে হয় না। তাই আমরা এখানে ঘর বানিয়ে থাকি। ঝুঁকি সম্পর্কে তিনি বলেন, ভয় তো আছেই। বৃষ্টি দিনে ভয় আরও বেড়ে যায়। কিন্তু আমরা গরীব মানুষ। জায়গা কেনার সামর্থ নেই। ঘর ভাড়া করাও অনেক খরচের। তাই ঝুঁকি নিয়েই এখানে থাকি।

তিনি জানান, স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা তাদের এই টিলায় ঘর বানিয়ে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টিলার উপরে ও পাদদেশে বসবাসকারী বেশিরভাগ লোকজনই দরিদ্র। স্থানীয় প্রভাবশালীরা টিলা কাটা ও দখলের জন্য দরিদ্রশ্রেণির লোকজনদের বসিয়েছেন। আবার কম টাকায় পেয়ে টিলার পাদদেশে জমি কিনেও ঘর বানিয়েছেন অনেকে। সোমবার জৈন্তাপুরে নিহত পরিবারও টিলার পাদদেশে জমি কিনে ঘর তুলেছিলো।

বাংলাদেশ পরিবশে আইনবিদ সমিতির (বেলা) হিসেবে সিলেট নগর, সদর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় প্রায় ৪শ পাহাড়-টিলা রয়েছে। এসব টিলার উপর ও পাদদেশে অনেক পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে। কি পরিমাণ পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে তার হিসেব নেই বেলার কাছেও।

তবে পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্যা হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট’র প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই বলেন, আমরা বছর চারেক আগে একটা জরিপ চালিয়ে দেখেছিলাম জেলায় টিলার পাদদেশে প্রায় ১০ হাজার মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছেন। এখন এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে।

তিনি বলেন, বসবাসের জন্য এসব টিলার অনেকাংশ কেটে ফেলায় টিলাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে এগুলো ধসে পড়ে প্রাণহাণির ঘটনা ঘটে। অপরিকল্পিতভাবে টিলা কাটা, বৃক্ষ উজাড় ও টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসের ফলে বৃষ্টি হলেই টিলা ধসে পড়ছে বলে মত পরিবেশকর্মীদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের হাওলাদারপাড়া, আখালিয়া, পীরমহল, ব্রাহ্মণশাসন জাহাঙ্গীরনগর, তারাপুর চা বাগান এবং নগরের উপকণ্ঠের বালুচর, বিমানবন্দর সড়ক, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, জোনাকী, ইসলামপুর মেজরটিলা, মংলিরপাড় এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েক শ’ পরিবার। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার।

কী পরিমাণ লোক টিলার উপর ও পাদদেশে বসবাস করেন এমন তথ্য নেই জানিয়ে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল বশিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের উপজেলায় কয়েকটি ইউনিয়নে এরকম টিলার পাদদেশে লোকজন বসবাস করেন। আমরা বর্ষা শুরুর আগেই তাদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করিয়েছি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছি। তবু তারা সরে যাননি।

ইউএনও বলেন, জৈন্তাপুরে আগে এমন দুর্ঘটনা ঘটেনি। তাই ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের কোন তালিকা করা হয়নি আমাদের। তাদের নিরাপদ জায়গায় সরানো বা অপসারণেরও কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখন এ ব্যাপারে ভাবতে হবে।

একই ধরণের তথ্য জানিয়ে জৈন্তাপুরের চিকনাগুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, টিলার পাদদেশে যারা আছেন তাদের সরে যাওয়ার জন্য আমরা প্রতিবছরই প্রচারণা চালাই। কিন্তু তারা যেতে চায় না।

এই জনপ্রতিনিধি বলেন, টিলার নিচে কম টাকায় জমি কিনে অনেকে ঘর বানায়। কেউ কেউ কম ভাড়ায় বা কেউবা আবার বিনে ভাড়ায়ও থাকে। ফলে তারা অন্যত্র যেতে চায় না। টাকা বাঁচানোর জন্য তারা জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে। প্রত্যেকেই ভাবে তার কিছু হবে না। অথচ আজকেও চারজন মারা গেলো।

এসব প্রাণহানির জন্য প্রশাসনের গাফিলতিকে দায়ী করে বাংলাদেশ পরিবশে আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, ২০১২ সালে আমাদের করা একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত সিলেটে পাহাড় টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। একই সঙ্গে পাহাড় টিলা সংরক্ষণ ও তার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষজনকে পুণবার্সসনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু ওই রায়ের ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়নি।

শাহেদা বলেন, কী পরিমাণ লোক ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করেন তারও কোন হিসেব নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। তাদের পুনর্বাসন বা টিলা সংরক্ষণে সরকারি কোন উদ্যোগ বা প্রকল্প নেই। বরং টিলা ধ্বংস করে অনেক প্রকল্প আছে। সরকারের এই নিষ্ক্রিয়তার কারণেই বারবার এই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে।

এই পরিবেশকর্মী আরও বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টিলাখেকোরা টিলা দখল ও কাটার জন্য দরিদ্রশ্রেণির লোকজনদের স্বল্পভাড়ায় বা বিনাভাড়ায় টিলার উপরে ঘর নির্মাণ করে দেয়।

সোমবার জৈন্তাপুরের দুর্ঘটনার পর হতাহতদের দেখতে ঘটনাস্থলে যান সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইমরুল হাসান বলেন, টিলার উপরে ও পাদদেশে যারা বসবাস করেন তাদের অনেকেই নিজের জমিতে ঘর বানিয়ে থাকেন। চেষ্টা করেও তাদের অন্যত্র সরানো যায় না। এবছরও আমরা সব ইউএনওদের মাধ্যমে মাইকিং করিয়ে টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে সওে যেতে বলেছি। কিন্তু কেউ কথা শুনেনি।

কী পরিমাণ লোক এরকম ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করেন তার কোন তালিকা নেই জানিয়ে ইমরুল হাসান বলেন, এরকম কোন তালিকা আমাদের নেই। তবে তাদের মধ্যে যদি কেউ ভূমিহীন থেকে থাকেন তাহলে প্রশাসন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের সরকারের আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হবে।

বিপি/এসকে