মাছের পোনা দেশের সোনা। কিন্তু এই সোনাসহ জলজ প্রাণীকে ধ্বংস করছে একশ্রেণির অসাধু মানুষ। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার উপকূলীয় জোন ও ফেনীর সোনাগাজী মধ্যবর্তী এলাকার সমুদ্র উপকূলীয় ফেনী নদীর বিভিন্ন স্থানে ও সাগরের মোহনায় নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবৈধভাবে অবাধে চলছে গলদা-বাগদা চিংড়ির রেণু আহরণ। রেণু আহরণ করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই ধ্বংস হচ্ছে হাজারো প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী।

নদীর বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দেখা যায়, নিষিদ্ধ মশারি ও ঠেলা জাল দিয়ে জেলেরা লাখ লাখ চিংড়ি রেনু আহরণ করে বিক্রি করছে স্থানীয় ব্যাপারীদের কাছে। ব্যাপারীরা সেগুলো দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছে খুলনা, বাগেরহাট ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন চিংড়ি ঘের মালিকদের কাছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় ভরদুপুরে রেগুলেটরের উপরে কোন মানুষ নেই। রেগুলেটরের উপরের চিত্র একদম ফাঁকা নিচের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। ফেনী নদীতে তখন শতশত মানুষ নিষিদ্ধ মশারি ও ঠেলা জাল দিয়ে চিংড়ির রেনু আহরণ করছে এবং এ রেনুগুলোর জন্য ধ্বংস করছে অন্য হাজারো মৎস ও জলজ প্রজাতি।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

কাজটি অবৈধ হলেও প্রকাশ্যেই চলছে। যারা চিংড়ির রেনু ধরছে অবৈধ কাজ হিসেবে তাদের মধ্যে কোন ধরনের ভয়-ভীতি নেই। তাদের বক্তব্য সবাইতো ম্যানেজ, ধরবে কে? টাকার ভাগতো সবাই পায় ব্যবস্থা নিবে কে?

চিংড়ির আহরণ এবং মৎস্য প্রজাতির এ ধ্বংস লীলা দেখা যায় প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত। অথচ প্রজনন মৌসুম থাকায় এ সময়টাতে নদীতে মাছ ধরার প্রতি রয়েছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা।

ফেনী নদীর মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকা থেকে শুরু করে মিরসরাই উপজেলার ইছাখালী, বামনসুন্দর খাল পর্যন্ত এবং ছোট ফেনী নদীর কাজীর হাট স্লুইস গেইট থেকে দক্ষিণে সন্দ্বীপ চ্যানেল পর্যন্ত বিশাল উপকুলীয় এলাকায় প্রতিদিনই লক্ষ লক্ষ চিংড়ি পোনা আহরণ করা হচ্ছে। এতে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, মিরসরাই ও সোনাগাজী উপকুলীয় অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ শুধু নদীতে চিংড়ি পোনা আহরণ করেই তাদের জীবিকা নির্বাহও করছে।

এসব স্থান ঘুরে দেখা যায়, জেলে, শিশু ও বৃদ্ধ সবাই মশারি ও ঠেলা জাল নিয়ে চিংড়ি রেনু আহরণ করছে। জেলেরা শুধু বাগদা-গলদা চিংড়ির রেনু সংগ্রহ করে অন্যান্য মাছের রেনু ও জলজ প্রাণী ফেলে দিচ্ছে।

পোনা আহরণের জন্য এসব জেলেরা প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে তুলেছে অবৈধভাবে অসংখ্য টিনের ঘর। এখান থেকে ঢাকা, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার চিংড়ি ঘেরগুলোতে পোনা পাঠানো হয়। শুধু মুহুরী প্রজেক্ট এলাকা থেকেই দৈনিক লক্ষাধিক চিংড়ি পোনা বৃহত্তর ঢাকা ও খুলনা অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়।

মুহুরী রেগুলেটর এলাকায় গিয়ে দেখা এমন কয়েকজন মৎস্যজীবীর সাথে। কথা হয় অভিজিৎ মন্ডল নামের নামের এক মৎস্যজীবীর সাথে। তিনি এসেছেন খুলনা থেকে। তিনি জানান, চিংড়ির রেনু পোনা আহরণ করার জন্য তিনি দু’ মাসের জন্য এ এলাকায় এসেছেন। স্থানীয় মহাজনের মাধ্যমে তিনি নদী থেকে এ পোনা আহরণ করে প্রতি পিস ১টাকা ধরে বিক্রি করেন।

শাখাওয়াত নামের খুলনা থেকে আসা আরেকজন জানান, তিনি প্রতি বছরই এপ্রিল-জুন তিন মাসের জন্য এলাকায় চিংড়ির রেনু পোনা আহরণের জন্য আসেন। স্থানীয় কালু মিয়া মহাজনের মাধ্যমে তিনি পোনাগুলো বিক্রি করেন। একই এলাকা থেকে আসা আরেক জেলে জানান, তারা নদী থেকে মশারির জাল দিয়ে অন্য পোনাসহ চিংড়ির পোনাগুলো আহরণ করেন। পরে চিংড়িটা রেখে অন্যগুলো ফেলে দেন।

মনু মিয়া নামের স্থানীয় একজন জানান, চিংড়ির রেনু সংগ্রহ করার সময় কোরাল, কাকড়া, চিরিং, বাইলা, মলা, ডেলা, চেউয়া, তফসে, বাটা, চাপিলা, কুচিয়া, টেংরা, পোয়া, লইট্টা, ভেটকি, ইলিশ, কাচকিসহ আরো অনেক প্রজাতির পোনা আসে। তারা শুধু চিংড়ি পোনা আহরণ করে বাকিগুলো ফেলে দেন। তিনি জানান, প্রতিটি চিংড়ির তারা ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন। অন্য মাছের পোনা নষ্ট হলে তাতে তাদের কোনো সমস্যা নেই।

এসব অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা বলছেন, আমরাও বুঝি আমরা অনেক মাছের জাত ধংস করছি। কিন্তু কী করবো? এই সময় কোনো কাজ না থাকায় জীবনের তাগিদে বাধ্য হয়ে এই রেনু আহরণ করছি। তারা জানান, খুলনা, বাগেরহাট যশোর এলাকার ঘের মালিকরা স্থানীয় মিরসরাই ও সোনাগাজি এলাকার আড়তদারদের মাধ্যমে চিংড়ি রেনু সংগ্রহ করে। আড়তদাররা হকারের মাধ্যমে জেলেদের কাছ থেকে রেনু সংগ্রহ করে। সবাই নির্দিষ্ট হারে কমিশন পায়। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি পোনা ১ টাকায় বিক্রি করলেও। খুলনা পর্যন্ত যেতে তার দাম পড়ে তিন টাকার মত।

মুহুরী রেগুলেটর এলাকায় চিংড়ির রেণু আহরণ কারী মনুু মিয়া নামের একজন ছবি তুলতে দেখে মন্তব্য করছিলো ‘সবতো ম্যানেজ, ছবি-টবি তুলে কোন কাম হবেনা’। এলাকার বাসিন্দা আজগর হোসেন জানান, প্রশাসনের সামনে দিয়েই ড্রামে ড্রামে চিংড়ির এসব রেনু যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়েই চলছে অবৈধ কারবার।

স্থানীয়রা বলছেন নিজাম জমিদার, মফিজ জমিদার (ক্যারপেডি), ওবায়দুল হক সহ অন্যরা প্রকাশ্যে ছোট ছোট ঘর করে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর থেকে লোক এনে এ ব্যবসা পরিচালনা করছে। সবার সামনেই ড্রামে করে নিয়ে যাচ্ছে এসব পোনা, নেয়া হয়না কোন ধরনের ব্যবস্থা।

কবির আহম্মদ নামের এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, এ অবৈধ কাজের ফলে নদী মাছ শূণ্য হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক আশ্রয়ে সিন্ডিকেটটি নদীর মাছ ধ্বংস করে দিচ্ছে। তিনি জানান, এ অবৈধ কাজের জন্য বড় ধরণের কোন জেল, জরিমানার নজির নেই। যা হয় তা লোক দেখানো এবং নামকা ওয়াস্তে।

স্থানীয়রা জানায়, এক সময় এ অঞ্চলে অনেক মাছ পাওয়া যেত। এভাবে চিংড়ির আহরণ করতে গিয়ে মাছের অনেক প্রজাতি ধংস হয়ে গেছে, যার ফলে নদীতে আর আগের মত মাছ পাওয়া যায়না। এলাকার সাধারণ মানুষ বলছেন, প্রাকৃতিক উৎস্য হতে বেপরোয়াভাবে এই রেনু ধরা বন্ধ করার দরকার। অনেকে অভিযোগ করেন, এক শ্রেণীর লোভী ব্যবসায়ী স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করেই অবাধে চলাচ্ছে এ রেনু সংগ্রহ।

এ বিষয়ে কথা হয় বিশিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মো. সাইফুদ্দিন শাহ এর সাথে। তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে চিংড়ির রেনু পোনা ধরা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। তারপরও সাগর মোহনা অঞ্চলের গরীব মৎসজীবীদের ঠেকানো যাচ্ছেনা। তারা অবৈধভাবেই নদী ও খাল থেকে গলদা ও বাগদার রেনু পোনা আহরণ করছে। এ প্রবণতা আরো বেড়ে গেছে বিগত কয়েক বছরে হ্যাচারী গুলোতে কৃত্রিমভাবে পোনা উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে।

এখন ঘের মালিকরা সবাই গলদা চিংড়ির জন্য প্রাকৃতিক মৎস সম্পদের উপরই পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে আছে। এর ফলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ দিনদিন মারাত্মক ক্ষতির সমুক্ষীন হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, একটি গলদা বা বাগদা চিংড়ির রেনু পোনা আহরণ করতে গিয়ে অন্য ৪৬৩ প্রজাতির মাছের রেনু পোনা ধ্বংস হয়। আর সাথে নদীর পানিতে বাস করা ক্ষুদ্র জীব কণা ধরা হয় তাহলে তার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭৬৩টি। এটা সার্বিকভাবে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ। এটা কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রন করা না গেলে বাংলাদেশের নদীগুলো ধীরে ধীরে মাছ শূন্য হয়ে যাবে। আর নিয়ন্ত্রন করা গেলে বাংলাদেশের মৎস সম্পদ বাড়বে দিনকে দিন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মিরসরাই উপজেলা সিনিয়র মৎস কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদ বলেন, আমরা প্রতিবছর অভিযান পরিচালনা করি। এবছরও অভিযান হবে। সব সময় না পারলেও মৌসুমে মাঝে মধ্যেই আমরা অভিযান পরিচালনা করি। অবৈধভাবে চিংড়ি রেনু ধরার কাজে ব্যবহারিত জাল ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং চিংড়ি পোনাগুলো নদীতে ফেলে দেয়া হয়।

তিনি আরও জানান, এই রেনু আহরণে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ইলিশের। এতে হাজারো জলজ প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য দরকার ব্যাপক গণসচেতনতা ও জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান।

বিপি/এএস