গোপালগঞ্জে অস্বাভাবাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে ব্রয়লার মুরগির দাম। এতে ক্রেতা সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় বিরুপ মন্তব্য করছেন স্থানীয়রা। মুরগির দামের লাগাম টেনে ধরতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ক্রেতারা।

অপরদিকে মুরগির খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বাচ্চার দাম বৃদ্ধি এবং কৃত্তিম সংকটের কারণে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও খামারিরা।

তবে সচেতন মহল বলছেন বাচ্চা সংকট ও খাবারের মূল্যবৃদ্ধি আসলে কৃত্রিম সংকট। বাজার মনিটরিং না থাকায় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমত দাম বাড়িয়েছেন। প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর বলছে, উৎপাদন আগের মতই আছে, হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

গোপালগঞ্জের পাঁচ টি উপজেলায় বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখায় গেছে, কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। মুরগির দাম বৃদ্ধি হওয়ায় খামারী, ব্যবসায়ী ও ক্রেতা সাধারণের কেউ খুশি নন। দাম বৃদ্ধিতে একে অপরকে দোষারোপ করছেন ।

খাবার ও মুরগির বাচ্চার দাম বাড়ার কারণে মুরগির দাম বাড়লেও লাভবান হচ্ছে না কেউ। তবে বাচ্চা উৎপাদনে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বেশি দাম নেওয়ায় লাভবান হচ্ছেন বাচ্চা উৎপাদনকারি হ্যাচারি মালিক ও বিক্রেতারা। ব্রয়লার মুরগির ওজন অনুপাতে দাম নেয়া হচ্ছে। দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ব্রয়লার মুরগির দাম নেয়া হচ্ছে কেজি প্রতি ২৫০ টাকা। ওজন আরও বেশি হলে তার দাম ২৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। লেয়ার ও কক মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকা থেকে ৪২০ টাকায়। দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত।

কাশিয়ানী উপজেলার পোনা গ্রামের পোল্ট্রি খামারি সাজেদা বেগম জানান, তার মুরগি পালনে ৪টি শেড রয়েছে। হঠাৎ বাচ্চার স্বল্পতা ও দাম বেড়ে যাওয়ায় ২টি শেড বন্ধ রেখেছেন। বাকি ২ টি শেডে ১৫০০ ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা নিয়েছেন ৩০ দিন আগে। আর ১৫ দিন পর তিনি মুরগি বিক্রি শুরু করবেন। উৎপাদনকারি ফার্ম থেকে অনলাইনে অর্ডার করে আনেন তিনি। দুই মাস আগে যে বাচ্চা কিনতেন ১০ থেকে ১২ টাকায়, সেই বাচ্চার দাম বেড়ে হয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। দাম দিলেও চাহিদা অনুযায়ী বাচ্চা পাননি বলেও জানান তিনি। এর আগে মোটা অংকের টাকা লোকসান করেছেন। মুরগির দাম বেড়েছে বলে এবার কিছু লাভের আশা করছেন। বাচ্চা সংকট ও দাম কমলে বন্ধ শেড গুলিতেও মুরগি পালন করার ইচ্ছা রয়েছে তার।

প্রাণী সম্পদ বিভাগ থেকে তিনি কোনরূপ সহায়তা পাননি এমন অভিযোগ করে বলেন, প্রাণী সম্পদ অফিস থেকে আমাদের কোন খোঁজ নেয়না। ওষুধ পথ্য ঠিকমত পাওয়া যায়না। যাও বা পাওয়া যায় তা হয় তো বা মেয়াদোত্তীর্ণ বা নিম্ন মানের।

এসকল ভ্যাকসিন বা মেডিসিন প্রয়োগ করলে মুরগি মারা যায় এবং অসুস্থ হয়, তাই বাইরে থেকে মেডিসিন কিনে ব্যবহার করেন।

বর্তমানে মেডিসিনের দাম বেড়েছে দ্বিগুন। এভাবে চলতে থাকলে গোপালগঞ্জ জেলার পোল্ট্রি খামারিরা পথে বসবে।

হরিদাসপুর গ্রামের পোল্ট্রি খামারি খলিল মিয়া জানান, এখন অনেকেই মনে করছেন মুরগির দাম বেড়েছে। আসলে বাচ্চা, খাবার ও মেডিসিনের দাম হিসেব করলে মুরগির দাম কম। তবে সকল সুবিধাভোগীদের কারণে ব্রয়লার ক্রেতা দামে দিশেহারা হয়েছে এটা সত্য। তবে এর লাভ আমরা যারা খামারি রয়েছি তারা পাচ্ছিনা। লাভ পাচ্ছেন বাচ্চা উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান ও খাবার উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান। বাচ্চার চাহিদা দিলে বাচ্চা নেই বলে দাম বেশি চাচ্ছেন অনেক হ্যাচারির ডিলাররা।

এবিষয়ে বাচ্চা বিক্রেতা কয়েকজন ডিলারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তারা কথা বলতে চাননি।

গোপালগঞ্জ শহরের মুরগি ব্যবসায়ী আনোয়ার মিয়া জানান, যে মুরগি পাইকারি কিনতাম ৯০ থেকে ১১০ টাকা। সেই ব্রয়লার মুরগি এখন পাইকারি ২৩০ থেকে ২৩৫ টাকায় কিনে ২৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। মুরগির দাম বৃদ্ধি হওয়ায় ক্রেতাও কমে গেছে। যারা সপ্তাহে দু’দিন মুরগি কিনতে আসতেন তারা সপ্তাহে একদিনও আসছেনা। আবার যারা আসছেন তারা কম করে কিনছেন। দাম কম হলে সারাদিন ক্রেতা লেগেই থাকতো। এখন বাজার প্রায় ক্রেতা শুন্য।

কাশিয়ানী উপজেলার মাজড়া বাজারের পোল্ট্রি মুরগী ব্যবসায়ী বুলু মোল্লা জানান, মুরগির দাম বেশি এটা মানুষের চোখে পড়ছে। কিন্তু একটি মুরগিতে কয় কেজি খাবার খায়, খাবারের দাম কত, বাচ্চার দাম কত এসব হিসেব করা হলে মুরগির দাম তুলনামুলক কম। তবে মুরগির দাম বেড়েছে এটা সঠিক। দাম বাড়ার কারণে ক্রেতাও কমেছে। আমাদেরও বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। খাবার ও বাচ্চার দাম নিয়ন্ত্রণ করা হলে মুরগির দাম এমনিতেই কমে যাবে। কারণ ছোট বড় সকল খামারিরা তখন মুরগি পালন করতে আগ্রহ দেখাবে। ফলে মুরগির উৎপাদন বৃদ্ধি হলে চাহিদা পূরণ হবে।

ব্রয়লার ক্রেতা জসিম মোল্লা জানান, ব্রয়লার মুরগির দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকাবস্থায় বাড়িতে বেহমান আসলে গরু ও খাসির মাংসের অনেক দাম। কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই এবং তা দিয়ে আত্মীয়তা ও মেহমানদারি করা যায়না। খুব সহজেই মেহমানদারি করা যেত ব্রয়লার মুরগি দিয়ে। এখন আর সেই সুযোগও থাকছেনা। এক কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ২৫০ টাকা। অর্থাৎ ৫০০ টাকার নিচে মুরগি হচ্ছেনা। আমরা গরিব ও দিনমজুুর মানুষ। এতো দামের ব্রয়লার খাওয়া খুবই কষ্টের।

শুধু জসিম মোল্লা-ই নয়, ব্রয়লার মুরগির দোকানে কথা হয়, ইমরান ও আঁখি বেগম এর সাথে, তারা বলেন, ১১০ থেকে ১২০ টাকার ব্রয়লার মুরগি হঠাৎ ২৫০ টাকা কেজি। আমরা আত্মীয়দের আপ্যায়ণ ও পরিবারের চাহিদার জন্য ব্রয়লারের বাজারে গিয়ে বুক ফেটে যাচ্ছে। এটা দেখার দায়িত্ব সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের। তা-না-হলে সরকারের ভাবমুর্তি নষ্ট হবে, সেই সাথে ক্রেতা সাধারণ দিশেহারা হয়ে থাকবে।

গোপালগঞ্জ শহরের ফিড ব্যবসায়ী মোঃ অহিদুর রহমান জানান, আমরা যেভাবে খাবার কিনছি সেই ভাবে বিক্রি করছি। তবে খাবারের দাম কেজি প্রতি তিন থেকে চার টাকা বেড়েছে । আবার অনেকেই এমন সুযোগ নিয়ে বেশি দামেও বিক্রি করার কথাও জানান তিনি।

গোপালগঞ্জ জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ গোবিন্দ চন্দ্র সরদার জানান, গোপালগঞ্জ জেলায় ছোটবড় প্রায় সাড়ে সাতশো টি ব্রয়লার মুরগির খামারি রয়েছে। ব্রয়লার মুরগি পালনে বিভিন্নভাবে সব ধরেনর সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ব্রয়লার উৎপাদনে প্রণোদনার মাধ্যমেও খামারিদের সহায়তা ও উৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে বিভিন্ন সংকটে কতগুলি খামার বন্ধ রয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই জেলা অফিসে। মুরগির দাম বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান বাচ্চা উৎপাদন করে থাকে। বাচ্চা উৎপাদনকারি হ্যাচারিগুলি ঢাকায় রয়েছে। বিভিন্ন ডিলারের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় বাচ্চা বিক্রি করে। বাচ্চা উৎপাদনকারি হ্যাচারিগুলো দাম বৃদ্ধি করেছে এ বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। এসময় ব্রয়লার মুরগির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে সারা দেশে। তবে বাচ্চা ও খাবারের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি তদারকিতে রাখা হয়েছে। আমরা আমাদের দপ্তর থেকে যে পদক্ষেপ নেয়ার বিধান রয়েছে সে মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণ করবো বলে জানান তিনি।