স্বাচ্ছন্দ্যে বহন, আধুনিকতা, অর্থঝুঁকি নিরসন- বর্তমানে চলার পথে মানুষ একসাথে সবকিছুই প্রত্যাশা করে। ব্যাংকিং খাতে এসব কিছুর বড় সমাধান ক্যাশলেস লেনদেন। সম্প্রতি ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে অর্থ আদান-প্রদান করা ক্যাশলেস লেনদেন বা নগদ টাকাবিহীন লেনদেনের বড় উদাহরণ তৈরি করেছে। করোনার পরবর্তী সময়ে অনলাইনভিত্তিক শপগুলোতেও আগ্রহ বাড়ছে মানুষের। ফলে অনলাইন থেকে পণ্য ক্রয়ে নগদ টাকার পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এবং ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমেও টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। এতে আগের তুলনায় ব্যাংকের কার্ডে বেড়েছে ই-কমার্স লেনদেন। গত এক বছরে যার পরিমাণ বেড়েছে ২ হাজার ৯৬ কোটি টাকা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি সময়ে অনলাইন কেনাকাটা লেনদেন হয় ১০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। এরপরের বছর একইসময়ে ১২ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা লেনদেন হয়। অর্থাৎ এসময় কার্ডে অনলাইন কেনকাটায় লেনদেন বেড়েছে ২ হাজার ৯৬ কোটি টাকা।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, আগে অনেক গ্রাহক কার্ড নিতে চাইতো না। এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। অনেকেই কার্ড ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন, কার্ডের সুবিধার উপর ভিত্তি করে ব্যাংক হিসাব খুলছেন। তাছাড়া গ্রাহকদের ক্রয় পদ্ধতির পরিবর্তনের কারণে কার্ডের ওপর কার্ড নির্ভরতা বাড়ছে। ব্যাংকের বুথ থেকে নগদ টাকা তোলার পাশাপাশি টাকার প্রয়োজনে কারও কাছে না গিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও পরিষেবার জন্য এই কার্ড ব্যবহার করা যায়।

করোনার সময়ে ই-কমার্স ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ঘরবন্দী মানুষ নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এবং সরকারের নির্দশনা মানতে ঝুঁকে অনলাইন কেনাকাটায়। পাশাপাশি শারিরীক সুরক্ষার জন্য মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এবং কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনের আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন লজিস্টিক সার্ভিসের মাধ্যমে হোম ডেলিভারি সেবা প্রদান করায় অনলাইন সেবা আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ই-কমার্সে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৭২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৭৭২ কোটি টাকা। সে হিসাবে বছরের ব্যবধানে ই-কমার্সে লেনদেন বেড়েছে ৩০০ কোটি টাকা। আর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই লেনদেনের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে ই-কমার্সে লেনদেন বেড়েছে ৮২৫ কোটি টাকা।

এদিকে ই-কমার্স খাতে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এলে এই খাতে গ্রাহকদের আস্থাহীনতা তৈরি হয়। অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অগ্রিম টাকা নিয়ে দীর্ঘদিনেও পণ্য বা সেবা সরবরাহ করছে না। এ নিয়ে ২০২১ সালের জুনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি নির্দেশিকা জারি করে। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই নির্দেশনার আলোকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পরিশোধ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা অর্থ নিজস্ব সেটেলমেন্ট হিসেবে ধারণ করবে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পণ্য সরবরাহের পর দাম পাবে। লেনদেন নিষ্পত্তিতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যাংক, এমএফএস বা ই-ওয়ালেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জুনে ই-কমার্সে লেনদেন বেড়ে রেকর্ড ১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা হয়েছিল। কিন্তু ই-কমার্স প্রতারণার প্রভাবে এক মাসের ব্যবধানে তা কমে দাঁড়ায় ৭৪২ কোটি টাকায়। তবে সরকারের ডিজিটাল কমার্স আইন ২০২১ প্রণয়নের পর গত বছরের এপ্রিলে আবার হাজার কোটির মাইলফলক স্পর্শ করে এই খাতের বেচা-কেনা। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) ২ হাজার ২৫১ কোটি টাকার লেনদেন হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইভ্যালি, কিউকম, আলাদীনের প্রদীপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো জালিয়াতিতে না জড়ালে কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ আরও বাড়তে পারতো। তাছাড়া সম্ভাব্য উদ্যোক্তারাও বাজারে একটা জায়গা নিতে পারতো। কিন্তু বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণায় গ্রাহকদের মাঝে আস্থাহীনতা তৈরি করেছে। এতে রেকর্ড করা লেনদেনের পরের মাসেই পতন ঘটেছে। সম্প্রতি সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে আস্থা ফিরতে শুরু করে খাতটিতে। এর ফলে ই-কমার্সে কেনাবেচা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ক্রেডিট কার্ডে নির্ভরতা বাড়ছে
অনলাইন কেনাকাটা ছাড়াও ক্রেডিট কার্ড আরও বিভিন্ন খাতে ব্যবহৃত হয়। বুথ থেকে টাকা তোলার পাশাপাশি নগদ টাকার অনুপস্থিতিতে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করা যায়। এতে কার্ড থেকে নেওয়া নির্দিষ্ট ঋণ ৪৫ দিনে শোধ করা যায় কোন সুদ ছাড়াই। আবার অনেক ব্যাংক শুধুমাত্র একটি পরিষেবা চার্জসহ ছয় মাসে সুদ-মুক্ত ঋণের প্রস্তাব দেয়। শুধু দেশের মধ্যেই নয় বিদেশেও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বৈদেশিক মুদ্রায় পণ্য ও সেবা কেনা যায়। এছাড়া কার্ডে ডলার লেনদেনের চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, কোভিড-১৯ লকডাউনের ২ বছর পর জীবন স্বাভাবিক হওয়ার সময় থেকে লেনদেন বেড়েছে। যদিও বেশিরভাগ মানুষ এখনও নগদ অর্থ ব্যবহার করেন। তবে প্রতিদিনের লেনদেনে নগদ অর্থের ব্যবহার কমছে। তাছাড়া বাজারে অর্থপ্রবাহ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্যাশলেস লেনদেনের প্রতি বেশি নজর দিচ্ছেন।

মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম, অনলাইন সিআইবি রিপোর্ট, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, প্রিপেইড কার্ড ও বিভিন্ন প্রযুক্তির এটিএম এসব সেবার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

বিপি/আজাদ