ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নানান অনিয়মের কারণে চলমান অর্থবছরে আমানত খাতে উত্থান-পতন অব্যাহত ছিলো। তাতেও চলতি সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ কোটি ১১ লাখ ৩৭ হাজার ২৫৬টি। যেখানে আমানত হিসেবে জমা রয়েছে ১৬ লাখ ১৩ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা রয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ১৯২টি। কোটি টাকার ওপর এসব হিসাবে জমা আছে ৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে বয়ে চলা আর্থিক সংকটের মাঝেও কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

তাতে দেখা যায়, তিন মাস আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৬২ লাখ ৪৯ হাজার ৭৬৪টি। যেখানে জমা ছিল ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি। কোটি টাকার ওপর এসব হিসাবে জমা ছিল ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, ১ কোটি ১ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকার আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ১০১টি। যাদের হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ ১ লাখ ৮১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। ৫ কোটি থেকে ১০ কোটির মধ্যে রয়েছে ১২ হাজার ৪০টি হিসাব। তাদের হিসাবে জমার পরিমাণ ৮৪ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০টি ক্যাটাগরিতে করা কোটি টাকার আমানতকারীদের হিসাবের মধ্যে ১ থেকে ১০ কোটি আমানতি হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ১৪১টি বা প্রায় ১ লাখ।

এছাড়া ১০ কোটি ১ থেকে ১৫ কোটির টাকার হিসাব রয়েছে ৩ হাজার ৮৭৫টি, ১৫ কোটি ১ টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে ১ হাজার ৮৭৪টি, ২০ কোটি ১ টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে ১ হাজার ১৪৫টি, ২৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ৮৮৭ জনের, ৩০ কোটি ১ থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৪৯৯টি এবং ৩৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৩২৭ আমানতকারীর হিসাব। ৪০ কোটি ১ থেকে ৫০ কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা ৬৪৬টি। এ ছাড়া ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৫৮টি। এসব হিসাবে জমার পরিমাণ ৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা।

বৈশ্বিক সংঘাতে প্রতিটি দেশে দেখা দিয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশে গত মাসে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ বা রেকর্ড পরিমাণ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান ছিলো। অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির ফলে একজন ব্যক্তিকে ১০০ টাকার কোন পণ্য বা সেবা কিনতে গড়ে খরচ করতে হয়েছে ১১০ টাকা। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কয়েক গুণ বেড়েছে। তাতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মাঝে হিমশিম খাওয়া জীবনযাপনে সঞ্চয় শব্দটি মানুষের কাছে বড় কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাতে কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে একটু অসঙ্গতির দৃষ্টিতে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।

তাদের মতে, মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ সংসারের ব্যয় মেটাতে পারছে না। ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে পারছে না। এমন অবস্থায় ব্যাংক টাকা জমানো দূরের কথা, অনেকে আগের জমানো অর্থ তুলে ব্যয় মেটাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতেও একশ্রেণির মানুষের আয় বেড়েছে। এরা হচ্ছে বিত্তশালী বা বড় প্রতিষ্ঠান। এটা থেকেই দেশে বৈষম্য বৃদ্ধি পায় বলে মন্তব্য করছেন তাঁরা।

এক বছরে আগে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৭৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৯৩। যাদের হিসাবে জমা ছিল ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। ওই সময় কোটি টাকার বেশি হিসাব ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯৭টি।

তবে কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ ব্যাংকে ১ কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতিদের হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালে ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর বেড়ে কোটিপতি হিসাব দাড়ায় ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬টিতে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোটা টাকার হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি।