Top
সর্বশেষ
জুলাই বিপ্লবে আহত আরও ৬ জনকে পাঠানো হলো ব্যাংককে হত্যা মামলায় সাবেক মেয়র আতিকের চার দিনের রিমান্ড আইকিউএয়ার সূচকে আজ ঢাকার বাতাসের মান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ যুদ্ধবিরতির মধ্যেও লেবাননে ইসরায়েলের হামলা, আহত ২৪ রাজশাহী রেলস্টেশনে হামলার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত আটক তুরাগ তীরে প্রস্তুত ইজতেমার মাঠ, আজ থেকে আসবেন মুসল্লিরা রেলের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার, ট্রেন চলাচল শুরু বিক্রি হবে বেক্সিমকো ফার্মা ও শাইনপুকুর সিরামিকের বন্ধকি শেয়ার দুর্বল ব্যাংকের গ্রাহকরা ধাপে ধাপে টাকা ফেরত পাবেন: গভর্নর ডিসেম্বরকে সামনে রেখে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে: ইসি সানাউল্লাহ

গাজীপুরে বন্ধ ৫১ শিল্প কারখানা, বেকার অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক

২৭ জানুয়ারি, ২০২৫ ২:০৬ অপরাহ্ণ
গাজীপুরে বন্ধ ৫১ শিল্প কারখানা, বেকার অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক
রায়হানুল ইসলাম আকন্দ, গাজীপুর প্রতিনিধি :

শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরে ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ৫১টি শিল্প কারখানা বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। এসবের মধ্যে ৪১টি কারখানা স্থায়ীভাবে এবং ১০টি কারখানা অস্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।

এছাড়াও বিভিন্ন সমস্যা থাকায় আগামী মে মাস থেকে কেয়া গ্রুপের আরো সাতটি কারখানা বন্ধ করার ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। এসব কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক। অনিশ্চয়তার সামনে রেখে এসব বেকার শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা মানবেতর দিনযাপন করছেন। গাজীপুর বর্তমানে বিক্ষোভের নগরীতে পরিনত হয়েছে।

বন্ধ কারখানা খুলে দেয়া ও বকেয়া বেতনের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করে ভাংচুর, বাসে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা করছে বিক্ষোভকারী শ্রমিকেরা। এসব কারণে প্রায়ই গাজীপুরের সড়ক-মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যানজটে আটকা পড়ে দুর্ভোগে পড়ছেন যানবাহনের চালক, যাত্রী ও পথচারীরা। বিক্ষোভকারী শ্রমিকদের সামাল দিতে সড়কে যান চলাচলসহ আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ গ্রামীণ টিলিকম ট্রাস্ট্রের মালিকানাধীণ গ্রামীণ ফেব্রিক্স এন্ড ফ্যাশন লিমিটেডে অগ্নি সংযোগ করে বিক্ষোভকারী শ্রমিকেরা।

বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে মহানগরীর সারাবো এলাকার বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিল পার্কের ১৬টি, টঙ্গির সাতাইশ এলাকার টিএমএস অ্যাপারেলস, কোনাবাড়ীর এলাকার পলিকন লিমিটেড, অ্যাপারেল প্লাস, টিআরজেড, দি ডেল্টা নিট, কালিয়াকৈরের চন্দ্রা এলাকার নায়াগ্রা টেক্সটাইল এবং মাহমুদ জিন্স। ব্যাংকিং এবং আর্থিক জটিলতায় এসব কারখানা বন্ধ হয়েছে। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।

গাজীপুর মহানগরীর জরুন এলাকার কেয়া গ্রুপে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। ওই কারখানায় বেশিরভাগ শ্রমিক শ্রবণ বাক ও প্রতিবন্ধী। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছরে হাজার কোটি টাকার বৈদিশিক মুদ্রা আয় করে। ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষ ১লা মে থেকে ৪টি এবং ২৭ মে থেকে ২টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধের নোটিশ দিয়েছেন। এগুলো কেয়া কসমেটিকস লিমিটেড (নিট কম্পোজিট গার্মেন্টস ডিভিশন, নিটিং বিভাগ, স্পিনিং ডিভিশন, কটন ডিভিশন) ও কেয়া ইয়ার্ন মিলস লি. (জরুন, কোনাবাড়ী, গাজীপুর)।

নোটিশে কেয়া গ্রুপের মালিক পক্ষ উল্লেখ করেছেন, বর্তমান বাজার অস্থিতিশীলতা, ব্যাংকের সঙ্গে হিসাবের অমিল, কাঁচামাল অপর্যাপ্ততা ও কারখানার উৎপাদন কার্যক্রমের অপ্রতুলতার জন্য কারখানাগুলোর সব কর্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হলো। শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাংলাদেশ শ্রম আইনের বিধি অনুযায়ী সব পাওনা কারখানা বন্ধের পরবর্তী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে পরিশোধ করা হবে।

কেয়া গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, রাজনৈতিক কারণে বিগত সরকারের সময় থেকে দুদক ৭টি মিথ্যা মামলা করেছে মালিকের বিরুদ্ধে। যার মধ্যে ৫টিতে ইতিমধ্যে মালিক নির্দোষ প্রমান হয়ে খালাস পেয়েছেন। তাছাড়া একটি ব্যাংক কোম্পানীর সাথে হিসাব নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে রফতানী বাধাগ্রস্থ করছে। এসব কারণে কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি ধাপে শ্রমিকদের সব পাওনা শ্রম আইন অনুযায়ী পরিশোধ করা হবে।

গত ১৫ ডিসেম্বর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের এক সভায় বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬টি কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। বন্ধের কারণ হিসেবে জানা যায়, কারখানাগুলোতে অর্ডার না থাকা ও ব্যাংকে ঋণখেলাপি থাকায় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। বন্ধ ঘোষিত এসব কারখানা খুলে দেয়ার দাবিতে সড়ক মহাসড়কে নেমে আন্দোলন করছে ৪২ হাজার শ্রমিক।

বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের সিনিয়র জেনারেৃল ম্যানেজার (প্রশাসন) এস এম আব্দুল লতিফ জানান, তাদের কারখানায় ৪২ হাজার শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী বেকার হয়ে মানবেতনর জীবন যাপন করছে। আমরা লে-অফ তুলে নিয়ে সরকারের সহযোগিতা চাইছি। প্রধান উপদেষ্টাসহ সকলের কাছে আমরা অনুরোধ করছি ব্যাক টু ব্যাক এলসি ওপেন করে সকল ব্যাংকিং সুবিধাসহ লে-অফ তুলে নেয়ার।

বকেয়া বেতনসহ অন্যান্য পাওনা পরিশোধের দাবিতে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকার ডার্ড কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। দুই শতাধিক শ্রমিক তাদের সাত মাসের বকেয়া বেতনসহ অন্যান্য পাওনা পরিশোধের দাবিতে জানিয়ে আসছে। সাত মাসের বকেয়া বেতনসহ প্রভিডেন্ট ফান্ড, সার্ভিস বেনিফিটের টাকা পাইনি তারা। বেতনসহ অন্যান্য পাওনা সাত মাস যাবত আটকে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। বারবার মালিকপক্ষ প্রতিশ্রুতি দিয়েও মালিকপক্ষ তাদের বকেয় বেতন পরিশোধ করছে না দাবী শ্রমিকদের।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের গাজীপুর মহানগর সভাপতি শফিউল আলম বলেন, এক বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া ডার্ড কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেড শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ও অন্যান্য পাওনা, সার্ভিস বেনিফিট, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা, নারী শ্রমিকদের প্রসূতিকালীন টাকা এখনও পরিশোধ করেনি। শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে সরকার ইতোমধ্যে মালিককে সুদমুক্ত ১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, ঋণ পাওয়ার একমাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত সব শ্রমিক ও স্টাফের মাঝে ঋণের টাকা বিতরণ করেননি মালিক। যার ফলে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। ঋণের ১৩ কোটি টাকা পরিশোধ করার পরেও অবশিষ্ট ১৪ কোটির টাকার বেশি অর্থ বকেয়া থাকবে শ্রমিক-কর্মচারীদের। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতরে ধরনা দিয়ে কোনও কাজ হচ্ছে না।

শফিউল আলম আরও বলেন, গত ২২ নভেম্বর ২০২৩ কারখানাটি স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করেন মালিকপক্ষ। বন্ধ হওয়ার দিন পর্যন্ত প্রায় আট হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। শ্রমিকদের কর্মকালের কয়েক মাসের বেতন এবং বন্ধকালের আইনানুগ পাওনাদি পরিশোধ সংক্রান্ত ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা চুক্তি সই হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী সরকার থেকে পাওনা ঋণের ১৩ কোটি টাকা পরিশোধ করার কথা রয়েছে। এর পরেও ১৪ কোটি টাকা পাওনা থাকবেন শ্রমিকরা।

ডার্ড গ্রুপের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার ফয়েজ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ইতোমধ্যে শ্রমিকদের আট ৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেছি। একসঙ্গে সব টাকা পরিশোধ করা যায় না। বাকি টাকা অবশ্যই পরিশোধ করে দেবো।

তিনি আরো বলেন, ৫ আগস্টের পর গাজীপুরের বেশকিছু কারখানা বকেয়া বেতনের কারণে বন্ধ হয়েছে। কিছু কারখানার মালিক আওয়ামী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল, তারা নানা কারণে অনুপস্থিত থাকায় কারখানাগুলো বন্ধ হয়েছে। এসব কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এখানো অনেকগুলো কারখানায় শ্রম অসন্তোষ রয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ নিসরসনে সরকারের পক্ষ থেকে তৃপক্ষীয়ভাবে যেসব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন ছিল, সরকার তা করেনি। যে কোন অসন্তোষ নিরসনে সরকারের উচিত শ্রমিকদেরকে সড়ক থেকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা। আলোচনার মাধ্যমে ন্যায় সংগত সমাধানে শ্রমিকদের পাশে থাকা।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের তথ্যমতে জেলায় ছোটবড় নিবন্ধিত কারখানা রয়েছে ২ হাজার ১৭৬টি। এরমধ্যে তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ১৫৪টি। এসব কারখানার মধ্যে নভেম্বর মাস থেকে ৩৫টি পোশাক কারখানা তাদের কর্মীদের বেতন দিতে পারেনি, যা মোট কারখানার ২ শতাংশ। ডিসেম্বর মাস থেকে বেতন বকেয়া পড়েছে ৪৫ ভাগ কারখানার। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে গাজীপুরের ৫ শতাংশ কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ রয়েছে। ৯ শতাংশ কারখানায় বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) নিয়ে জটিলতা চলমান। বাস্তবতা হলো ১ হাজার ১৫৪টি তৈরি পোশাক কারখানার মধ্যে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে ৪১টি এবং অস্থায়ীভাবে ১০টি কারখানা বন্ধ রয়েছে।

গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২ এর পুলিশ সুপার (এসপি) এ কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন কারণে জেলায় ৫১টি শিল্প কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় ব্যাংকিং সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে। কারখানা খুলে দেয়া ও বকেয়া বেতনের দাবিতে কর্মহীন শ্রমিকদের অনেকেই সড়ক মহাসড়কে নেমে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এসব শ্রমিকদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এনজে

শেয়ার