Top

চরাঞ্চলে গবাদি পশুর চারণভূমি হুমকির মুখে

০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ৪:৩৩ অপরাহ্ণ
চরাঞ্চলে গবাদি পশুর চারণভূমি হুমকির মুখে

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের উপকূলীয় চরাঞ্চল এক সময় গবাদি পশুর উর্বর চারণভূমি ছিলো। উপযুক্ত চারণভূমি থাকার সুবাদে মিরসরাইয়ের অন্যতম অর্থকারী সম্পদের মধ্যে মহিষ ছিল অন্যতম। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় কিংবা শীত উপেক্ষা করে মহিষ দলবদ্ধভাবে চরে বেড়ায় ও ঘাস খায়। কিন্তু মিরসরাই ইকোনোমিক জোনে চরাঞ্চলের জমি অধিগ্রহণের কারণে হুমকির মুখে গবাদিপশুর চারণভূমি। এতে ভয়ানক দুশ্চিন্তায় পড়েছেন স্থানীয় গরু-মহিষ পালনকারীরা।

উপজেলার ইছাখালী ও ওচমানপুরের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর একমাত্র পেশা গরুমহিষ পালন। চরাঞ্চলের পতিত জমিতে অবাধ বিচরণ ছিল গবাদিপশুর। যেদিকে দুচোখ যেতো, সবুজ আর সবুজ। ঘাস খাইয়ে গরু মহিষ মোটাতাজা করে তার বিক্রয়লব্ধ অর্থে চলে একেকজন রাখালের পরিবার। কিন্তু বর্তমানে উন্নয়নের ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে সেসব সবুজ। সবুজের বদলে এখন চোখে পড়ে ধু ধু বালি। এ যেন কৃত্রিম মরুভূমি। পতিত চরাঞ্চলে গড়ে উঠছে দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল।

মিরসরাইয়ে যখন থেকে লেগেছে শিল্পের ছোঁয়া তখন থেকেই হারাতে বসেছে গবাদি পশুর চারণভ‚মি। অধিকাংশ রাখাল পরিবার ছেড়ে দিয়েছে গরুমহিষ পালন। যার ফলশ্রুতিতে বেড়েছে ঐসকল মহিষ পালনকারী পরিবারের অভাব অনটন।

মিরসরাইয়ের চরাঞ্চলের মহিষের দুধ থেকে উৎপাদিত দইয়ের ব্যাপক জনপ্রিয়তা সমগ্র উপজেলাজুড়ে। মহিষের দুধ ও দই বিক্রি করে সংসার চালায় চরাঞ্চলের মহিষ পালনকারীরা। মিরসরাইয়ের ইছাখালী ও চরশরৎ অঞ্চলের প্রধান পেশা মহিষ পালন। ভোরে সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শত শত মহিষের পাল নিয়ে বিস্তৃত চরের দূর সীমানায় ছুটে যান মহিষ পালকেরা। স্থানীয় গৃহস্থরা প্রায় অধিকাংশ পরিবার পালন করে একাধিক মহিষ। এসব মহিষগুলো সারাদিন চরে বেড়ায় ইছাখালী ও চরশরৎ এলাকার উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বাগানগুলোতে। খাবার খেতে খেতে দল বেধে ডুব দেয় পানিতে। আবাদকৃত জমি থেকে যখন ফসল ঘরে উঠানো হয় তখন মনের সুখে দাবরিয়ে বেড়ায় কালো কালো মহিষের পাল। চরাভূমিতে জন্মানো প্রাকৃতিক ঘাস, জলাভ‚মির কচুরিপানা ও বিভিন্ন জাতের লতাপাতা মহিষের প্রধান খাদ্য। খাবার খেয়ে মহিষগুলো পালে পালে গা ডোবায় ডোবা কিংবা খালে। কিছু কিছু পাল দলবেধে চলে যায় উপকূলীয় জলাভুমিতে। সেখানে পানিতে গলা সমান ডুবে থেকে জাবর কেটে দিনশেষে খোয়াড়ে ফিরে। কিন্তু চরাঞ্চলে এখন আর চোখে পড়ে না বড় বড় মহিষের পাল।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ছোট ছোট দু একটা মহিষের পাল খাবারের খোজে ধু ধু বালিতে চরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেখানে নেই কোনো সবুজ ঘাস। নেই গা ভিজিয়ে ডুবে থাকার মত পানি। এ যেন ধু ধু মরুভূমি। খাবারের খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে হাপাচ্ছে মহিষের দলগুলো। এতদিন যেসব পতিতভূমি ছিল মহিষদের খাবারের অভয়াশ্রম, এখন সেখানে ধু ধু বালুচর। যে চরাঞ্চল ছিল সবুজ ঘাসে ভরপুর, সেখানে আজ গড়ে উঠছে ভারি শিল্প। যার ফলে বিপাকে পড়তে হচ্ছে মহিষপালকদের। এসময় কথা হয় একজন মহিষপালকের সাথে। তার নাম সিরাজুল ইসলাম। তিনি মহিষ পালন করেই নির্বাহ করেন তার ছয় সদস্যের পরিবার। সিরাজুল ইসলাম জানান, একসময় সারাবছরই আমরা ৫০-৭০টা পর্যন্ত মহিষ একসাথে পালন করতাম। কিন্তু এখন এখানে শিল্পাঞ্চলে কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে যাওয়ায় আমরা আর ততবেশি মহিষ পালন করতে পারছি না। এখন আমি সর্বসাকুল্যে ২০ থেকে ২৫টা মহিষ পালন করি। ঘাসের অভাবে এ অল্পসংখ্যক মহিষ পালন করতে আমিসহ আমার মত যত মহিষ পালক আছে প্রত্যেককেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ফসলী জমিতে যখন ফসল বপন করা হয় তখন দুর্দশা বাড়ে চরমে। মহিষগুলো চরার জন্য কোনো জায়গাই থাকে না তখন। এসময় ঘাস খাওয়াতে না পেরে অনেকে লোকসানের মুখে কম মূল্যে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। এখন অঞ্চলের অনেকেই ছেড়ে দিয়েছে মহিষপালন। এতে হুমকির মুখে মহিষের সুস্বাদু দুধ ও দধি উৎপাদন।

মহিষ মূল্যবান গৃহপালিত গৃহসম্পদ। মহিষপালন অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিপুল অবদান রাখে। মহিষের শিং হতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপজাত যেমন বোতাম, চিরুনী, চাবুক ও চুরির হাতল তৈরী হয়। গ্রামাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে মহিষকে জমি চাষ দেয়ার প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মহিষের দুধ খুবই সুস্বাদু ও উপকারী। মহিষের দুধ থেকে তৈরী হয় দই। এই দই বাজারে বেশ সমাদৃত ও চড়াদামে বিক্রি করা যায়। মহিষের গোবর সাধারণত কৃষকরা জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে এবং অনেকে এটি জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করেন। এছাড়াও মানুষের প্রয়োজনীয় প্রাণীজ আমিষের একটি বড় অংশ পূরণ করে মহিষের মাংস।

কিন্তু চারণভূমির জন্য এসকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে মিরসরাই উপজেলা। এভাবে দিনদিন চারণভূমি কমতে থাকলে একসময় মিরসরাইতে গণহারে কমতে থাকবে মহিষপালন।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিনহাজুর রহমান বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ফলে তার থেকে যে দেশিয় আয় আসবে তা পশু পালন থেকে কয়েকশত গুন বেশি হবে। তবে এ কথাও সত্য যে দেশিয় আয় বৃদ্ধি পেলেও হ্রাস পাবে স্থানীয় আয়। যে সকল মহিষ পালনকারীরা পালে পালে মহিষ পালন করতেন তাদের পেশা হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের নতুন পেশায় পুণর্বাসন করা অতীব জরুরী।

শেয়ার