Top

সংস্কারের অভাবে দেশের দ্বিতীয় রেল স্টেশনটি এখন স্থবির

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ৩:৩৪ অপরাহ্ণ
সংস্কারের অভাবে দেশের দ্বিতীয় রেল স্টেশনটি এখন স্থবির
রাজবাড়ী প্রতিনিধি :

সময় ও কাল বিবেচনায় রাজবাড়ী বাংলাদেশের দ্বিতীয় রেলওয়ে স্টেশন। যার পরিচিতি মূলত রেলের শহর হিসেবেই। ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ আমলে তৈরি রেলস্টেশনটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় ও ট্রেনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় স্টেশনটি স্থবির হয়ে পড়েছে।

তিন যুগ আগে এ রেলপথে ১২টি ট্রেন চলাচল করত। ওই সময় যাত্রী ও শ্রমিকদের কোলাহলে রেলস্টেশনটি সারাক্ষণ প্রাণবন্ত ও মুখরিত থাকত। সেই প্রেক্ষাপটে স্টেশনটির এখন চারদিকে এখন শুধুই সুনশান নীরবতা। সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ এ স্টেশনটিতে একটি মেইল, একটি আন্তঃনগর ও একটি লোকাল ট্রেন ছাড়া আর কোন ট্রেনই থামে না।

ব্রিটিশ শাসন আমলে কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে যোগাযোগ এবং পদ্মা পাড়ে ব্যবসা বিস্তারের জন্য তৎকালীন রাজবাড়ীর জমিদার সূর্য কুমারের দেয়া কাচারি ঘিরেই রাজবাড়ী রেলস্টেশন ও পরে শহর গড়ে ওঠে।

৩০-৩২ বছর আগেও এ স্টেশন জুড়ে থাকত মানুষের ব্যস্ততা। জ্বলতো চকচকে আলো। সেখানে এখন ভুতুড়ে পরিবেশ। সকল ট্রেন না থামায় রাজবাড়ী স্টেশনে দিনের অধিকাংশ সময়ই থাকে নীরব। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলেই শুরু হয় মাদকসেবী ও সন্ত্রাসীদের আনাগোনা।

ব্রিটিশদের তৈরি স্টেশনের লাল ভবনটি এক সময়ের বিখ্যাত রাজবাড়ী রেলস্টেশন। ভবনে ফাটল ধরায় দুই বছর আগে পরিত্যক্ত ভবনটির ছাদ ভেঙে ফেলে নতুন করে ছাদ তৈরি করে চলছে কার্যক্রম। যাত্রীদের জন্য এ স্টেশনে নেই কোনও টয়লেটের ব্যবস্থা। সবসময় বন্ধ থাকে ওয়েটিং রুম। সংস্কারের অভাবে ক্ষয়ে গর্ত হয়ে গেছে প্লাটফর্ম।

১৯৮০ সালেও যেখানে ৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল এখন সেখানে এখন মাত্র ৭-৮ জন কর্মকর্তা দিয়ে কোনোরকমে চলছে স্টেশনটির কার্যক্রম। শ্রেণিগতভাবে স্টেশনটি প্রথম শ্রেণির হলেও মান্ধাতার আমলের অবকাঠামো আর জনবল সংকটের কারণে যাত্রীসেবা নেই বললেই চলে।

নিরাপদ ও সহজলভ্য ভ্রমণের জন্য এখানে দিন দিন যাত্রীর সংখ্যা বাড়লেও দূরের যাত্রীদের জন্য টয়লেট ব্যবস্থা ও বিশ্রামাগার না থাকায় নেহাত ঝামেলাই পোহাতে হয় যাত্রীদের। সর্বোপরি রাজবাড়ী ও এর আশেপাশের রেলস্টেশনগুলোতে যাত্রীসেবার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। প্রায় দুইশ বছরের পুরোনো ব্রিটিশদের গড়া ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ী রেলওয়ে স্টেশন। প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জন্য একটি মাত্র টয়লেট থাকলেও তা সব সময় বন্ধ থাকে। আর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির যাত্রীর কোনও টয়লেট ব্যবস্থা নেই। তবে রেল কর্তৃপক্ষ জানায়, ইচ্ছা থাকার পরেও জনবল সংকটের কারণে আশানুরূপ সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। ১৮৬১ সালের ১৫ নভেম্বর বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রথম রেলগাড়ি চলেছিল। এর এক বছর পর ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির তৈরি সেই সময়ে ব্রডগেজ রেলপথ ধরে রানাঘাট থেকে দর্শনা ও জগতি হয়ে একটি ট্রেন এসে থেমেছিল রাজবাড়ীর এই রেলস্টেশনে। ঊনবিংশ শতাব্দিতে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রেল কোম্পানি ভারতবর্ষে শুধু অর্থনৈতিক কাজের জন্য রেলপথ চালু করে। তখন থেকে রেলকে ঘিরেই রাজবাড়ী শহর হিসেবে গড়ে উঠেছিল।

ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ অঞ্চল বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বর্তমান রাজবাড়ী জেলা শহরে রাজা সূর্যকুমারের কাচারির পাশে এই রাজবাড়ী রেলপথ ও স্টেশন নির্মিত হয়। পরবর্তীতে এখানে পদ্মার ইলিশ মাছ কলকাতায় পৌঁছানোর জন্য গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত এই রেল লাইন প্রসারিত করা হয়। ঢাকা থেকে স্টিমারের যাত্রী ও মাছ পরিবহনে এবং অর্থনৈতিক কাজে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে স্টেশনটি।

প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ছয়টি রুটে প্রতিদিন ২০-২২টি ট্রেন রাজবাড়ী থেকে যশোর, রাজশাহী, দর্শনা, খুলনা, সৈয়দপুর, ভাটিয়াপাড়া, ফরিদপুর ও পার্বতীপুরসহ বিভিন্ন রুটে চলাচল করত। এসব ট্রেনের বেশির ভাগই ছিল যাত্রীবাহী ও মালবাহী। সে সময় এই স্টেশন দিয়ে দিনে ৫-১৫ হাজার লোক যাতায়াত করতো। বর্তমানে রাজবাড়ী স্টেশনের তিনটি প্লাটফর্মে প্রতিদিন যাত্রীবাহী তিনটি ট্রেন ও পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের পাথরবাহী আরও একটিসহ মোট চারটি ট্রেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আসা-যাওয়া করে। ট্রেন যাত্রা আরামদায়ক ও স্বাচ্ছন্দ্য ভেবে দিনে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার যাত্রী এসব ট্রেনে চড়ে বিভিন্ন রুটে যাতায়াত করে থাকে। এরপরও পরিবহন ট্রেনে মালামাল ওঠানামা করে থাকে।

রাজবাড়ী স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা মনে করেন, এই অচলাবস্থার জন্য এখানে ট্রেনের সংখ্যা কমিয়ে দেয়াই মূল কারণ। সংস্কার না হওয়া, ট্রেনের অপরিকল্পিত সময়সূচি ও ট্রেন কমিয়ে দেয়াকে রাজবাড়ী স্টেশনটির এই করুণ অবস্থা সৃষ্টির মূল কারণ।

আর শ্রমিক নেতারা ও রেল কর্মকর্তা বলছেন, ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে দৌলতদিয়া ঘাট থেকে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করে রেলের আয় বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানো দরকার। তারা মনে করেন, পৃথিবীর অন্য দেশ হলে ইতিহাসের অংশ হিসেবে যত্ন নেয়া হতো রাজবাড়ী রেলস্টেশনের।

রাজবাড়ী রেলস্টেশনের মাস্টার তন্ময় কুমার বলছেন, স্টেশনটি আধুনিকায়ন করতে ও ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হবে।

শেয়ার