বৃষ্টির দিনে একটু বিশ্রাম নিতে হেলপারকে ট্রাক চালাতে দিয়ে পাশেই ঘুমিয়ে ছিলেন ড্রাইভার মাহমুদুল হাসান বাবু (৩৭)। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চালভর্তি ট্রাকটির গন্তব্য ছিল রাজধানী ঢাকা। রাজশাহী-ঢাকা সড়কের নাটোরের গুরুদাসপুরে ট্রাকটি রাস্তা থেকে নামিয়ে পাশের গাছে মেরে দেয় হেলপার। ঘুমন্ত অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে গুরুতর আহত হন ট্রাক ড্রাইভার মাহমুদুল। এতে প্রাণে বেঁচে গেলেও মেরুদণ্ড ভেঙে যায় তার।

মাহমুদুল হাসান চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রামের মো. মোশাররফ হোসেনের দ্বিতীয় ছেলে। সড়ক দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০১৬ সালের ০৬ জুন। এরপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে সেখানকার চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দেন। পরে ভারতের চেন্নাই নিয়ে যাওয়া হয় মাহমুদুল হাসানকে। কিন্তু অর্থাভাবে চিকিৎসা না করেই দেশে ফিরতে হয় মাহমুদুলকে।

২০১৬ সালে দেশে ফিরে আর কোন চিকিৎসা হয়নি মাহমুদুলের। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, প্রায় ৪ লাখ টাকা হলেই তার চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু অর্থাভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না তার। শয্যাশায়ী হয়ে ভাঙা মেরুদণ্ড নিয়ে বিছানায় পড়ে আছেন মাহমুদুল হাসান। উঠতে, বসতে বা চলাফেরা করতে পারেন না নিজে নিজে। মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ায় মাজার নিচ থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত পুরোপুরি অক্ষম মাহমুদুলের।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

চিকিৎসা না করার কারনে দেহের নিচের অংশে কোন শক্তি বা অনুভূতি নেই তার। সেই সাথে পচন ধরেছে পায়ের উরুর অংশে। পরিবার ও স্বজনরা টাকা তুলে একটি ঠেলাগাড়ি কিনে দিলেও বিছানায় তার সবসময়ের সঙ্গী। ব্যথা উপশমের জন্য প্রতিদিন খেতে হয় বিপুল পরিমাণ টাকার ওষুধ। গত ছয় বছর ধরে বিছানায় কাতরাচ্ছে দরিদ্র পরিবারের সন্তান মাহমুদুল। তবে ব্যয়বহুল হলেও চিকিৎসা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে বলে আশাবাদী তার পরিবার ও চিকিৎসকের।

শয্যাশায়ী মাহমুদুল হাসান বলেন, পরিবার-পরিজন নিয়ে সবকিছুই ভালোই চলছিল। ২০১৬ সালে হঠাৎ করে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আমার জীবন পাল্টে যায়। প্রাণ থেকেও এখন মৃত হয়ে বিছানায় পড়ে আছি। মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়ে গত ৬ বছর ধরে পঙ্গুত্ব জীবন-যাপন করছি। এখন অন্যের উপর নির্ভরশীল। অন্য কারো সহযোগিতা ছাড়া কিছুই করতে পারিনা। কেউ বসিয়ে রাখার পর সুইয়ে না দিলে ওভাবেই বসে থাকতে হয়। সুয়ে থাকলে ঘুরিয়ে না দিলে সেভাবেই সুয়ে থাকতে হয়। নিজের শক্ত-সামর্থ্য দিয়ে কিছুই করতে পারিনা।

তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ভারতে উন্নত চিকিৎসা নিলে আমি সুস্থ হব। এছাড়া বাংলাদেশেও এর চিকিৎসা করানো সম্ভব। এতে আমার দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা প্রয়োজন। ফিজিওথেরাপি নিতে হবে ও অপারেশন করতে হবে। এবাবদ প্রায় ৪ লাখ টাকা মতো খরচ হবে। সমাজের বিত্তবান ও অনেক প্রবাসী ভাই আমার মতো মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি। তাই সকলের কাছে অনুরোধ, আমাকে একটু সহযোগিতা করে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন।

মাহমুদুলের মা মোসা. মানেরা বেগম জানান, সবাই ছেড়ে চলে গেলেও আমি পারব না। নিজের শক্ত-সামর্থ্যে না হলেও আমি ছাড়া তার আর কেউ নাই। আমাকেই সবকিছু করতে হয়। বিছানা থেকে উঠানো, পোশাক পরিবর্তন করা, খাওয়ানো সব কাজ আমাকে করতে হয়। সকলের কাছে আমার ছেলের স্বাভাবিক জীবনটা ভিক্ষা চাই।

ট্রাক ড্রাইভার মাহমুদুলের ভাবী তাহমিনা আক্তার ও সৎ মা নাসিমা বেগম বলেন, আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয়। তার উপর এমন ব্যয়বহুল চিকিৎসা আমাদের মতো পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই চিকিৎসা করাতে না পেরে বিছানায় পড়ে আছে। সরকার বা সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে তার চিকিৎসা করানো সম্ভব।

স্থানীয় কলেজছাত্র তাসবিরুল ইসলাম শিমুল জানান, গত ছয় বছর ধরে মাহমুদুলকে এমন শয্যাশায়ী অবস্থায় দেখছি। মেরুদণ্ড ভেঙে অসহায় হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় চিকিৎসা ছাড়াই পড়ে আছে। আমাদের সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য তার চিকিৎসা করাতে পাশে দাঁড়ানোর।

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সমাজসেবা কর্মকর্তা ফিরোজ কবীর বলেন, সমাজসেবার মাধ্যমে সমাজের অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য প্রায় ৫৪ ধরনের সহায়তা প্রদান করা হয়। মাহমুদুল ক্ষেত্রে বেশকিছু ক্ষেত্রে সহায়তা করা সম্ভব। যেমন কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানে হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়ে রোগী কল্যান সমিতির মাধ্যমে সহায়তা পেতে পারে। এছাড়াও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে থাকা রোগী কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে এবং জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ জেলা শাখার সভাপতি বরাবর আবেদন করেও সরকারের আর্থিক সহায়তা পেতে পারে।

বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন-বিএমএ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. গোলাম রাব্বানী জানান, বর্তমানে মেরুদণ্ডের চিকিৎসা, নিউরো সার্জারি ও অর্থপেডিক সার্জারি ব্যবস্থায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা করালে চিকিৎসাব্যয় কম হয়। কিন্তু বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এসব চিকিৎসা অত্যান্ত ব্যয়বহুল। যা ট্রাক ড্রাইভারের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তাই সমাজের সকল মানুষের প্রতি তার পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানায়। অনেক দেরি হয়ে গেলেও মাহমুদুলের চিকিৎসা করাতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে বলে জানান, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. গোলাম রাব্বানী।

উল্লেখ্য, মাহমুদুলকে আর্থিক সহায়তা করা যাবে তার বিকাশ নম্বরে। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ও বিকাশ নাম্বার ০১৭৩১৬৪৫৫১৯।