ব্রিটিশ শাসনামলে ব্যবসা-বানিজ্যের সুবিধার্র্থে গড়ে তোলা ৪টি রেলস্টেশনের রেলসিটি খ্যাত সিরাজগঞ্জ শহরটি প্রায় রেলশূন্য হতে চলেছে। এক সময়ে ভোরে ট্রেনের হুইসেলে যে শহরবাসীর ঘুম ভাঙ্গতো ও শহরের মধ্য দিয়ে দিনরাত ঝক ঝকা ঝক ট্রেন চলাচলের শব্দে অসংখ্য মানুষের কোলাহলে মুখরিত থাকতো। অনেকের জীবীকাও নির্বাহ হতো এই রেল থেকেই। বর্তমানে সেই শহটিতে নামমাত্র একটি ট্রেন চলাচল করায় সিরাজগঞ্জবাসীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

যমুনার তীরে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জ শহরের পূর্বপাশে দেশের অন্যতম নৌবন্দরে ভিড়তো লঞ্চ, ষ্টিমার আর ফেরি। নৌবন্দরে থেকে শহরে ঢুকতেই রেলঘাটে প্রায় সব সময়ই দাঁড়িয়ে থাকতো কোনো না কোনো ট্রেন। প্রায় ৩ দশকের ব্যবধানে সেসব দৃশ্য এখন শুধু স্বপ্ন আর স্মৃতিই সিরাজগঞ্জবাসীর কাছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, উনিশ শতকের শুরুর দিকে পাক-ভারত উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনামলে ব্যবসা-বানিজ্যের সুবিধার্র্থে যমুনা নদীর তীরের সিরাজগঞ্জ শহরকে ঘিরে ৪টি রেলস্টেশনের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল রেলসিটি হিসেবেই। শহরে ট্রেন প্রবেশের প্রথম রেলস্টেশনটির নাম সিরাজগঞ্জ রায়পুর, পরের স্টেশনটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে সিরাজগঞ্জ বাজার, শহরের উত্তর পার্শ্বের সিরাজগঞ্জ বাহিরগোলা রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে একেবারে যমুনার পাড়ে সবশেষের স্টেশন সিরাজগঞ্জ ঘাটে গিয়ে থামতো। এ শহরটির একপাশে নৌবন্দর আর অপর পাশের রেলস্টেশনগুলোকে ঘিরেই নির্বাহ হতো শহরবাসীর জীবন-জীবিকা। সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশনের পূর্ব পাশে রেলওয়ে (জিআরপি) থানা ও বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে রেলওয়ের বিশাল ইয়ার্ড। ইয়ার্ডের ভিতরেই কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আবাসস্থল, ইঞ্জিন ঘোরানোর ব্যবস্থাসহ ট্রেন রক্ষণাবেক্ষণের কাঠের স্লীপার লোহার রেলপাত থরে থরে সাজানো থাকতো এবং গোডাউনে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ করে রাখা হতো।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের সময় থেকে সিরাজগঞ্জ শহরকে বাদ দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভুল পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদাসীনতায় পর্যায়ক্রমে ঐতিহ্য ও গৌরব হারাতে থাকে রেলসিটি খ্যাত সিরাজগঞ্জ জেলা শহর। এরপর ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পরও রাজশাহীগামী আন্তঃনগর পদ্মা ও খুলনাগামী আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনসহ, একটি মেইল ট্রেন ও একটি লোকান ট্রেন চলাচল করলেও পরবর্তীতে একে একে সব ট্রেন বন্ধ করে দেয়া হয়। সর্বশেষ বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেলপথ প্রকল্পটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে রেলসিটি সিরাজগঞ্জের নাম। সিরাজগঞ্জবাসীর সর্বশেষ আশার এ প্রকল্পটিতেও সিরাজগঞ্জ শহরকে রেলবঞ্চিত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটি ও শহরবাসীর চরম বিরোধিতা সত্বেও রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ কোন স্বার্থে কার ইশারায় শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে জংশন স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এতে একসময়ের রেলসিটি খ্যাত জেলা শহরটি রেলবঞ্চিত হবে বলে আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল।

এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ডাঃ জহুরুল হক রাজা বলেন, ব্যবসা-বানিজ্যের সুবিধার্র্থে তৎকালীন বৃটিশ সরকার চলনবিলের মধ্য দিয়ে ১৯১৫ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ করে। এর ফলে উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকাসহ সমগ্র পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। ট্রেনে সিরাজগঞ্জ হয়ে যমুনার পাড়ে সিরাজগঞ্জ ঘাট থেকে ষ্টিমারে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হয়ে ঢাকায় যাতায়াত করতো উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথের মাধ্যমে সিরাজগঞ্জ থেকে কোলকাতার সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সেসময় আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে ছিল, যেটা দার্জিলিং, শিলিগুড়ি থেকে ঈশ্বরদী হয়ে সিরাজগঞ্জে আসতো। এভাবে সিরাজগঞ্জের সঙ্গে সরাসরি কোলকাতার সংযোগ স্থাপিত হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতিসহ সর্ব ক্ষেত্রেই এগিয়ে যেতে থাকে সিরাজগঞ্জ। এখানকার কৃষিপণ্য যেত কলকাতায় আর কলকাতা থেকে বিভিন্ন পণ্য আসতো সিরাজগঞ্জে। সকালের ট্রেনে কোলকাতা গিয়ে কাজকর্ম শেষে আবার রাতের ট্রেনেই ফিরে আসা যেত। কোলকাতার প্রভাবে সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও সিরাজগঞ্জ অনেক এগিয়ে যায়। সিরাজগঞ্জের হরিহর শুক্লা ও তার মেয়ে হৈমন্তী শুক্লা, বাঁশরী লাহিড়ী ও তার ছেলে বাপ্পী লাহিড়ী ভারতীয় সঙ্গীতাঙ্গনে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সিরাজগঞ্জের যাদব চন্দ্র চক্রবর্তী কোলকাতায় থাকতেন। তাঁর ছেলে কোলকাতা থেকে সিরাজগঞ্জে এসে দাতব্য চিকিৎসালয়ও স্থাপন করেছিলেন।

প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ ডাঃ জহুরুল হক রাজা আরও বলেন, বগুড়া থেকে যে রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে, যদি সিরাজগঞ্জ জেলা শহরে জংশন না করা হয় তাহলে রেলসিটি খ্যাত এ শহরটির একেবারেই অপমৃত্যু ঘটবে। আমদানি-রফতানি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উপরও অনেক প্রভাব পড়বে জংশনের কারণে। স্থানীয় দৈনিক যমুনা প্রবাহর পত্রিকার সম্পাদক মোস্তফা কামাল বলেন, সিরাজগঞ্জ ছিল কোলকাতার কেন্দ্রস্থল। সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইলসহ সমস্ত এলাকার পাট ও কৃষিজাত দ্রব্য সিরাজগঞ্জ থেকে কলকাতা যাওয়ার জন্য রেলপথ প্রতিষ্ঠিত করে ব্রিটিশ সরকার। রেলভিত্তিক একটি শহরকে বাইপাস করে রেল থেকে শহরকে কেউ আলাদা করতে পারে না। যে শহর বন্দর কেন্দ্রিক, সেটা হবে নৌবন্দর, যে শহর রেল কেন্দ্রিক, সেখানে রেলশহর থাকতেই হবে। যারা এ শহরকে রেলবঞ্চিত করেছে, তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই। একদিকে বর্তমান সরকার রেল অধ্যুষিত দেশ গড়ে তুলছে, অপরদিকে রেলশহর সিরাজগঞ্জকে রেল থেকে বঞ্চিত করে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে একটি চক্র। অথচ ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনাসহ বিভিন্ন শহরের ভিতরেই অত্যাধুনিক রেলওয়ে স্টেশন নির্মান করা হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ রায়পুর, বাজার স্টেশনের পূর্ব পাশে ইয়ার্ড এলাকায় শত শত একর রেলের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে ইচ্ছে মতো লুটেপুেেট খাচ্ছে রেলওয়ের প্রভাবশালী এক শ্রেণির কর্মচারি। অথচ কৃষিভিত্তিক জায়গা-জমি নষ্টের মাধ্যমে একটি কুচক্রি মহল নতুন স্থানে জংশন করে করার পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এদিকে সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির সদস্য ও শ্রমিক আন্দোলনের বাসদ নেতা নব কুমার কর্মকার বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার পর রেলস্টেশন কড্ডার মোড়ে চলে যাওয়ায় সিরাজগঞ্জ জেলা শহরটি রেল বিচ্ছিন্ন হয়ে হাটখোলায় পরিণত হয়ে গেছে। সেটি নিয়ে হরতাল, মিছিল, মিটিং ও আন্দোলনের এক পর্যায়ে ২০১১ সালে মাননিয় প্রধানমন্ত্রী সিরাজগঞ্জের জনসভায় ঘোষণা দিয়ে গেলেন, রায়পুর জংশন হয়ে বগুড়া পর্যন্ত রেল সংযোগ হবে। পরবর্তীতে রেল মন্ত্রণালয়ের কোন কর্মকর্তার ইন্ধনে রেললাইন রায়পুরের পরিবর্তে কালিয়া হরিপুর দিয়ে বগুড়ায় নেয়া হচ্ছে। এতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রæতিকে অবমাননার পাশাপাশি সিরাজগঞ্জের আপামর জনগণের সঙ্গে প্রতারণাও করা হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সোহরাব আলী সরকার বলেন, এক সময় এখানে অনেক আন্তঃনগর ট্রেন, মেইল ট্রেন, লোকাল ট্রেন যাতায়াত করতো, সব সময় জাকজমকপূর্ণ থাকতো বাজার স্টেশন ও রায়পুর স্টেশন। এখন আর সেগুলো নেই। রায়পুরে জংশন না হলে রেলের জন্য বিখ্যাত সিরাজগঞ্জ শহরটার মৃত্যু ঘটানো ছাড়া আর কিছুই না। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট কে এম হোসেন আলী হাসান বলেন, আন্তঃজেলা মিটিংয়ে রায়পুরে রেলওয়ে জংশনের জন্য আলোচনা করা হয়েছিল এবং সকলেই মতামতও দিয়েছিল। এখন শোনা যাচ্ছে রায়পুর থেকে সামান্য কিছু দূর দিয়ে রেলজংশন করা হবে। বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মোঃ সুবক্তগীণ বলেন, সিরাজগঞ্জ শহরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে কথাটা সঠিক নয়। এক সময় সিরাজগঞ্জ রায়পুর ও সিরাজগঞ্জ বাজার দিয়ে সিরাজগঞ্জ বাহিরগোলা হয়ে যমুনা নদীর পাড়ে সিরাজগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত রেলপথে ট্রেন চলতো। তাই শহরের প্রতিটি স্থানকে গুরুত্ব দিয়েই সার্বিক বিবেচনায় দেখা গেছে, রায়পুর রেল জংশন করা হলে জমি অধিগ্রহণে প্রচুর অর্থ ব্যয় হবে। এ কারণে রায়পুর রেলওয়ে স্টেশনের ১ কিলোমিটারের একটু দূরে সিরাজগঞ্জ জংশন নির্মাণ করা হচ্ছে। যেখানে ৫/৬ টি রেল লাইন বসানো হবে। রায়পুর স্টেশনটি সিগন্যালিং সিস্টেমের আওতায় আনা হবে এবং সিরাজগঞ্জের ট্রেনগুলো সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশন থেকেই ছেড়ে যাবে। কিন্তু উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বাকি ট্রেনগুলো সিরাজগঞ্জ জংশন দিয়েই চলাচল করবে। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে প্রকল্পের ডিটেইলস ডিজাইন তৈরি ৭৫ ভাগ অগ্রগতি হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় যাওয়া হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, চলতি বছরের জুন মাসে ৮৬ কিলোমিটার বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের রেলপথের নকশা তৈরি, স্টেশনের সংখ্যা নির্ধারণসহ আনুসঙ্গিক সব কাজে ৫ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।