জীবিকার তাগিদে আশি ঊর্ধ্ব বয়সী মোকাদ্দেস আলী অনেক কষ্ট করে তাঁতকলে খটখট খটখট শব্দে গামছা তৈরি করেন। কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন জায়গায় ফেরি করে সেই গামছা বিক্রি করেন। বৃদ্ধা মোকাদ্দেস এখন ভাল করে হাঁটতে পারেন না। চোখের দৃষ্টিও আর আগের চেয়ে অনেক ঝাপসা। তার আত্মবিশ্বাস আর মনোবল অনেকের চেয়েও বেশি। ভিক্ষা না করে কষ্ট করে গামছা বিক্রি করেন। এতেই চলে সংসার। এতেই তিনি সুখী।

হাতে গামছা ও কাঁধে ব্যাগ নিয়ে গামছা বিক্রির সময় তাকে সালাম দিয়ে তার সাথে কথাবার্তা বলেন ক্রেতা, পথচারীরা ও পরিচিতরা। ক্রেতাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলেন তিনি। মোকাদ্দেস আলীর মুখের হাসি দেখে মনে হয় পৃথিবীর সব সুখ যেন সৃষ্টিকর্তা তাকেই দিয়েছেন। শহরের মানুষ তাকে গামছার ফেরিওয়ালা হিসেবেই চেনেন।

মোকাদ্দেস আলী কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আলামপুর ইউনিয়নের দহকুলা গ্রামের কারিগর পাড়ার মৃত খোদাবক্সের ছেলে। ৫ ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের বাবা তিনি। ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়েছে, তারা তাদের সন্তানদের নিয়ে পৃথকভাবে বসবাস করেন। ছেলেরা সবাই দিনমজুর। তারা আলাদাভাবে বসবাস করেন। বৃদ্ধা মোকাদ্দেস ৭৭ বছর বয়সী অসুস্থ স্ত্রী রুবিয়া খাতুনকে নিয়ে আলাদাভাবে বসবাস করেন। গামছা তৈরির কাজে তাকে সহযোগিতা করেন স্ত্রী রুবিয়া। রুবিয়া হার্টের অসুখ সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। নিয়মিত ঔষধ খেতে হয় তাকে।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

আত্মবিশ্বাসী এই বৃদ্ধার সাথে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘ ৩০ বছর যাবত পায়ে হেটে গামছা বিক্রি করে আসছেন মোকাদ্দেস। তার আগে ছোটবেলা থেকে প্রায় ৪০ বছর পায়ে প্যাডেলের ভ্যান চালিয়েছেন। বয়স বাড়লেও সবসময় কাজের সঙ্গে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। এই বয়সে বাড়িতে গামছা তৈরি করেন এবং সেই গামছা হাতে নিয়ে কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিয়ত ছুটে চলে তিনি। এভাবে ঘুরে ঘুরে গামছা বিক্রি করেন তিনি।

গামছার ফেরিওয়ালা মোকাদ্দেস আলী বলেন, বয়স বেড়েছে, শরীরের শক্তি হারিয়েছে, চোখে আর আগের মতো দেখি না। তবুও আল্লাহর রহমতে ভালো আছি, বড় ধরনের কোনো রোগ নেই। বাড়িতে হাতের তাঁতকলে খটখট খটখট শব্দে আমি নিজেই গামছা বুনি। গামছা তৈরির কাজে অসুস্থ স্ত্রী আমাকে সহযোগিতা করেন। সেই গামলা হাতে নিয়ে প্রতিদিন সকালে কুষ্টিয়া শহরে যায়। শহরের অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে গামছা বিক্রি করি। প্রতিদিন চার থেকে ছয়টি গামছা তৈরি করি ও সেগুলো বিক্রি করি। প্রতিটি গামছা ১৪০ থেকে ১৬০টাকায় বিক্রি হয়৷ এতে ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা লাভ হয়। গামছা তৈরি করতে খুব কষ্ট হয়, একাজে অসুস্থ স্ত্রী আমাকে সাহায্য করে। পথে ১০০ টাকার মতো খরচ হয়ে যায়। বাকী টাকা দিয়ে বাজার করি, স্ত্রীর ঔষধ কিনি এবং সংসার চালায়। আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।

তিনি আরও বলেন, আগা আমি পায়ের প্যাডেলের ভ্যান চালাতাম। ছোটবেলা থেকে শুরু করে ভ্যানচালক ছিলাম ৪০ বছর আর ৩০ বছর ধরে গামছা তৈরি করি আর বিক্রি করে বেড়ায়। বৃদ্ধ বয়সে গামছা তৈরি করতে কষ্ট হয়। বিক্রি করতেও কষ্ট হয়। কিন্তু জীবন জীবিকার তাগিদে এই কাজ করি। আমাকে দেখে বহু মানুষ সালাম দেয়। আমার সাথে সবাই গল্প করে। মানুষ আমাকে খুব ভালোবাসে। মানুষের ভালোবাসা আমাকে অনেক শান্তি দেয়। পথেঘাটে দেখি, আমার চেয়ে অনেক কম বয়সী শক্তিশালী মানুষ ভিক্ষা করে। জোয়ান-জোয়ান মানুষ ভিক্ষা করে, আমি ভিক্ষা করি না। কখনো কারো কাছে হাত পাতি না। গামছা বেচে খায়, এই-ই আমার খুব ভাল্লাগে। জীবনে দুঃখ কষ্ট সংকট আছে, আগামীতেও থাকবে। আমি কোনো সংকটকে সংকট মনে করি না। আল্লাহ চালিয়ে নেয় আমাদের।

কুষ্টিয়া শহরের ব্যবসায়ী রাসেল চৌধুরী বলেন, মোকাদ্দেস আলী দীর্ঘদিন ধরে কুষ্টিয়া শহরে ঘুরে ঘুরে গামছা বিক্রি করেন। তিনি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী মানুষ। এই বয়সে তিনি গামছা হাতে নিয়ে ছুটে চলে শহরের বিভিন্ন জায়গায়। তাকে দেখলেই ভালো লাগে। তিনি প্রাণোচ্ছ্বল ও কর্মঠ মানুষ। তিনি সবসময় হাসিখুশী থাকেন।

শহরের থানার মোড়ে এলাকার কয়েকজন বলেন, গামছা বিক্রেতা বৃদ্ধ মোকাদ্দেস আলী মানুষের সাথে হাসি মুখে কথা বলেন। তার মন খারাপ খুব কম সময়ই দেখেছি। হাসি, তামাশা ও গল্পগুজব করতে তিনি খুবই পছন্দ করে। এই বয়সে সবাই যখন শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে বিষন্নতায় ভোগে, তিনি তখন জীবিকার তাগিদে নিরন্তর ছুটে চলেন। বহু বছর আগে থেকে তিনি পায়ে হেটে গামছা বিক্রি করেন।

গামছা ক্রেতা হিল্লাল উদ্দিন বলেন, আমি ১৫০ টাকা দিয়ে একটা গামছা কিনলাম। এই বৃদ্ধা শহরের অলিগলিতে গামছা বিক্রি করে বেড়ায়। হাতে গামছা নিয়ে হেটে চলার সময় অনেকে তাকে দেখে গামছা কিনতে উৎসাহিত হয়। উনাকে এভাবে না দেখলে হয়তো আজ গামছা কিনতাম না।

স্থানীয়রা বলেন, মোকাদ্দেস খুবই পরিশ্রমী ও সাদাসিধা মানুষ। কয়েক যুগ আগে তিনি ভ্যান চালাতেন। গত ৩০ বছর আগে থেকে তিনি গামছা তৈরি করেন এবং পায়ে হেটে ঘুরে ঘুরে সেই গামছা বিক্রি করেন। তিনি খুবই আন্তরিক মানুষ। মানুষের সঙ্গে আপন মানুষের মতো আন্তরিকতার সাথে কথাবার্তা বলেন। তার ছেলেরা দিনমজুরী করেন। সবাই পৃথকভাবে বসবাস করেন। তাদের সংসারও কোনোরকমে চলে। বৃদ্ধ মোকাদ্দেস তার নিজ উপার্জনেই স্ত্রীকে নিয়ে খেয়েপড়ে বেঁচে আছেন।