বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার বগা ভাষা গ্রামটি জেলে পল্লি নামে পরিচিত, জেলা শহরের পূর্ব দিকে থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গ্রামটিতে বেশিরভাগ মানুষ জীবিকানির্বাহ সাগরে মাছ ধরে। প্রতিমুহূর্তে সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় তাদের । বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বিদায় নেন অশ্রুভেজা চোখে। আর হয়ত দেখা না ও হতে পারে স্বজন দের সাথে । তাদের এই আশঙ্কা অবশ্য কোথাও ভুল নয়। সাগরে স্রোতে ট্রলার ডুবি গত এক দশকে এই গ্রামেই মারা গেছেন অর্ধশত জেলে। এর মধ্যে অনেক পরিবার উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

জীবিকা তাগিদে, পরিবারের সকলকে রেখে, এই গ্রামের জেলে মহিদুল মোল্লা (৩৫)। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশ্যে গ্রামের জেলেদের সঙ্গে, ট্রলারে করে তিনিও মাছ ধরতে যান। ৪ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে, মহিদুলসহ, সকলের জেলেদের জীবনে নেমে আসে কালো রাত। ২১টি ট্রলার ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়, বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবনসংলগ্ন দুবলার চরে এলাকায় । এর মধ্যে অনেক জেলে সাঁতরে নিরাপদে আসতে পারলেও মারা যায় ৭ জন। এর মধ্যে একজন মহিদুল।

মহিদুল মোল্লার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের চাল ও কাঠের বেড়া দেওয়া ঘরটিতে তাঁর মা-স্ত্রী-সন্তান বসবাস করেন । অনেকটা জরজীর্ণ ঘরের বারান্দায় বসে জাল মেরামত করছেন মহিদুলের স্ত্রী মুর্শিদা বেগম। পাশেই বসে ছিলেন মহিদুলের মা হাসিনা বেগম।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মহিদুলের স্ত্রী মুর্শিদা বেগম বলেন, তিনটা ছেলে রেখে স্বামী মারা গেছেন। বড় ছেলেরে ১৭ পারার হাফেজ বানিয়েছিলাম। মনে অনেক আশা ছিল। কিন্তু ওর বাপ ( বাবা) মারা যাওয়ার পর ও নিজে কাজে গেছে। ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে খুব কষ্টে আছি। এখন দিনে দুই বেলা খেয়েও কাটে না খেয়েও কাটে। বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ ও দিতে পারি না। যেভাবে সব কিছুর দাম বেড়েছে সামনে কিভাবে চলব তা জানিনা। মাথায় কোনো কাজ করে না। সব উপরওয়ালার উপরে ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহ বাঁচাইলে বাঁচাবো না বাঁচাইলে আল্লাহ যেমন একজন নিছে সেইভাবে যেন আমাগো ও নিয়ে নেয়।

মহিদুল মোল্লার তিন ছেলের মধ্যে তরিকুল ইসলাম (১৫) সবার বড়। ১৭ পারা কোরআনের হাফেজ সে। দুই ছেলে আরিফুল (১৩) ও আবির (৯) স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের সপ্তম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবার মৃত্যুর পর তরিকুল পড়ালেখা ছেড়ে ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেয়।

হাসিনা বেগম বলেন, ঐ সর্বনাশা বঙ্গোপসাগর আমার একমাত্র আদরের সন্তানকে কেড়ে নিছে। যাওয়ার সময় বলে গেছেন যে, ‘মা টাহা ( টাকা) পয়সা তেমন কিছু থুইয়ে (রেখে) যাইতে পারলাম না। যা আছে তাই অল্প অল্প করে খাইয়ো। আর আল্লাহ আল্লাহ কইরো। আমি কয়েক দিনের মধ্যে আসতেছি। তহন আল্লাহ দিলে ভালো-মন্দ খাইয়ো’।ছেলের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসালেন এই মা। তিনি চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘তারপর থেকে সব অন্ধকার। আমি ছেলের মুখখানও শেষবারের মতও দেখতে পারলাম না’।

এমন চিত্র যে মহিদুলের স্ত্রী মুর্শিদা বেগেমের এমন তা নয়। একই গ্রামের বাসিন্দা হামিদা বেগম। তাঁর স্বামীর নাম লেকওয়াত মোল্লা। তাঁর স্বামীও মাছ ধরতে গিয়ে মারা গেছেন ২০১৬ সালে। তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, । ঘরের বারান্দায় বসে মাছ ধরার জাল ঠিক করছেন বৃদ্ধা। তিনি বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর ঘোর অমানিশা নেমে আমাগো জীবনে। মানুষের বাড়িতেও কাজ করে,ছোট দুই ছেলে নিয়ে কোনো রকমে খেয়ো না খেয়ে বাইছে আছি । শত কষ্টেও ছেলেদের লেখাপড়া করাচ্ছি ওগো নাইগে একটু দোয়া করেন।

এমন চিত্র শুধু মহিদুল মোল্লা ও লেকওয়াত মোল্লার পরিবারের না। একই চিত্র সাগর থেকে ফিরে না আসা সব জেলেদের পরিবারে।

কথা হয় স্বামী হারানো মরিয়ম বেগমের সঙ্গে। তাঁর স্বামীর নাম মো. তালেব। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে চারজনের পরিবার তাঁর। তিনি বলেন, ‘সাগর থেকে স্বামী ফেরেননি আট বছর হলো। টেনেটুনে চললে। জাল বুনে, পুকুরে মাছ ধরে কেন দিন চুলায় আগুন জ্বালে আবার কোন দিন জ্বলে না কীভাবে যে দিন কাটে, তা শুধু আমরাই জানি।

কথা হয় কলেজ সরকারী শহীদ শেখ আবু নাসের মহিলা কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী তাসলিমার সাথে, বাবা কে হারিয়েছে চার বছর, বাবার মৃত্যুর পর বাবাকে শেষবারের মতন ছুতেও পারিনি। , মা পরে বাসায় কাজ করে তাই দিয়ে আমরা দুই ভাই বোনলেখাপড়া করি, বাড়ি থেকে কলেজে যাওয়ার আসা দূরত্ব অনেক হড়জায় ১২০ টাকা প্রতিদিন কলেজে আসতে পারি না। আমাদের জন্য কি সরকারি কোন সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারেনা।

জেলে ও মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ২০১৫ সালে ১৯ জন এবং ২০২২ সালে ৮ জনসহ গেল ১০ বছরে বগা ও চারাখালি গ্রামের অন্তত ৩০ জন জেলে প্রাণ হারিয়েছেন।

কচুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমা আক্তার বলেন, বগা ও চারাখালি এলাকার জেলেরা খুবই আর্থিক কষ্টে থাকে। এখানে সব জেলে সরকারি চালও পায়না। এছাড়া ২০১৫ সালে মারা যাওয়া ১৯জনের পরিবার এখনও সরকারি সহযোগিতা পায়নি। জেলেদের কার্ড বৃদ্ধি ও নিহত জেলেদের সরকারি সহযোগিতার জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখা হয়েছে বলে জানান এই জনপ্রতিনিধি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম রাসেল বলেন, এক বছরে কচুয়ার পাঁচটি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে সাহায্য দেওয়া হয়েছে। জেলেদের নিরাপত্তায় ৪০০ ট্রলারে ‘ভেসেল ট্র্যাকিং মনিটরিং সিস্টেম’ বসানো হয়েছে।

এসকে