Top
সর্বশেষ

তালা বাবা গাইবান্ধায়

০১ জুন, ২০২১ ৬:১১ অপরাহ্ণ
তালা বাবা গাইবান্ধায়
আবু বক্কর সিদ্দিক :

১৯ বছর ভাত খান না তিনি। তিন বেলা তিনটা রুটি জুটলে আয়েস করে খান আর শহর গ্রাম হেটে অথবা ভ্যানে চলেন। মন যেদিকে চায় সেদিকে চলে যান। পরনে ঝকঝকে চটের লুঙ্গি আর বুকে ও শরীরে জড়ানো ষ্টিলের ও লোহার তালা আর শিকল ঝুলানো।

শরীরে সার্বক্ষনিক কমপক্ষে ২০ কেজি ভারী বস্তু বহন করেই চলেন অজানার উদ্দেশ্যে। এই ব্যক্তির নাম মনজিল ইসলাম। বয়স অন্তত ৬৫ বছর। বাবার নাম মেহের উদ্দিন। বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের মলাবান্দি গ্রামে। বাবা মেহের উদ্দিন ছিলেন ভারতের পীর খাজা তিস্তা খঞ্জন সাধুর মুরিদ। মনজিল ইসলামের বয়স যখন ১১ বছর তখন তার বাবা মেহের উদ্দিন তাকে নিয়ে চলে যান ভারতের সাধুর দরগায়।

সেখানে তার বাবার সাথে সাধুর আশ্রমে বড় হতে থাকেন। ১৯ বছর বাবার সাথে সাধুর আশ্রমে কাটিয়ে ৩০ বছর বয়সে চলে আসেন গাইবান্ধার নিজ বাড়িতে । তখন তার মাথায় বড় বড় জট পাকানো চুল আর পরনে ছিলো চটের বস্তা। শরীর জুড়ে লোহার বিভিন্ন তালা ও শিকল জড়ানো ।

এঅবস্থায় মা আসমা বেগম তার ছেলেকে চিনতে পেয়ে বাড়িতে আশ্রয় দেন। ছেলের এই পরিবর্তন দেখে আশ্চার্য্য হয়ে পড়েন। কি শীত কি গরম। তার গায়ে জড়ানো থাকে শুধু তালা, শিকল আর হাতে পায়ে ষ্টীলের বালা। তার পরেও সন্তান তো। তাকে তো আর ফেলে দেয়া যায় না। এলাকায় হৈ চৈ পড়ে যায় তাকে নিয়ে। দুরদুরন্ত থেকে লোকজন বাড়িতে আসে দেখতে। এক সময় তার নাম হয়ে যায় তালা বাবা । ঝাড়ফুক না করলেও লোকে তার চেহারা সুরুতে নাম রাখেন তালাবাবা। নিত্য দিনের খাওয়া বলতে রুটি। তিন বেলা তিন রুটিতে তার সন্তষ্ট। মা ভাবেন এই অবস্থায় ছেলেকে বিয়ে করাতে হবে। যদি ভালো ও আগের মতো স্বাভাবিক হয়। তাই পিতা মেহের মিয়া যখন ভারতে তখন তার অনুপোস্থিতিতে তার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে থাকেন ।

৩২ বছর বয়সে একই এলাকার সাহিদা বেগমের সাথে তার বিয়ে হয়। এরপরও ঘর সংসার বলতে সাধুর বেশ ছাড়তে পারেনি। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো আর রাতে বাড়ি ফেরা। তারপর একে একে সহিদুল, আমিনা, মমতাজ ও ফাতেমাদের পিতা হয়ে যান। বাড়ি ভিটা সহ ২ বিঘা জমির মালিক এই  কে মুখে কম কথা বলেন।

২০১৬ সালের কনকনে ঠান্ডার দিনে সকাল বেলা হঠাৎ করে উধাও হয়ে যান তালা বাবা। তিনি বর্ডার পার হয়ে চলে যান ভারতের সাধু বাবার আস্তানায়। সেখানে তার পিতার সাথে আবারও দেখা হয়। স্ত্রী সাহিদা বেগমের আর্থিক টানাটানির মধ্যে সন্তানদের বড় করেন। সংসারে ঘানি টানতে তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। চালান সংসার। এক সময় ছেলে সহিদুল কাজের সন্ধানে চলে যায় ঢাকায়। সেখানে গিয়ে গার্মেন্সকর্মী হিসাবে কাজ যোগার করে নেন। পিতার অনুপস্থিতে সংসারের হাল ধরেন।

২০১৯ সালে তিনি আবার চলে আসেন গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু বাড়িতে তিনি স্থায়ী হননি। তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। মাজারে মাজারে, পীরের দরগায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন। এবছরের শুরুতে তিনি আবার গাইবান্ধায় তার গ্রামের বাড়ি গিদারীতে আসেন। সকালে ১ টা রুটি খেয়ে বেড়িয়ে পরেন প্রকৃতি দেখতে। এ হাট ও হাট, এবার ও বাজার ঘুরে রাতে ফেরেন বাড়িতে। এরমধ্যে কেউ রুটি খেতে দিলে মহা খুশি। রুটি খেয়ে পান মুখে দিয়ে খেতে খেতে হেটে অথবা ভ্যানে ফিরে চলা। গাইবান্ধার কামারজানি সড়কের রেজিয়া মার্কেটের সামনে এই তালা বাবাকে দেখতে পেয়ে মোটরসাইকেল থামালাম। মোবাইলের ক্যামেরায় ছবি তুললাম কয়েকটি। কোন কথা নাই তার মুখে। চারপাশে লোকজন ঘিরে ধরলো। এর মধ্যে প্রশ্ন করলাম ক্যামন আছেন, আপনি কি করেন? আর গায়ে এসব কি? তিনি ঘর নেড়ে তাকিয়ে শুধু বললেন ছবি তুলেছেন আপনি। আপনার সাথে কোন কথা নাই।

তারপর তার বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রী সাহিদা বেগমের কাছে জানলাম তিনি পাগল মানুষ। কখন কোথায় যায়, কি খায় তা জানা কঠিন। তবে বাড়িতে ভাত খায়না ১৯ বছর ধরে। আগে খেতেন। এই লাইনে যাওয়ার পর আর ভাত খেতে পারেন না। স্ত্রী সাহিদা আরও বলেন, সে কারও ক্ষতি করে না। কম কথা বলেন। ইচ্ছে হলে কথা বলেন, আর না হলে নাই। শরীরে লোহার শেকল, স্টীলের তালা, হাতে বালা পরানো হয়নি কোন দিন। তিনি নাকি এসব স্বপ্নে পেয়েছেন। সে কারণে গায়ে জড়িয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখেন সব সময়।

শেয়ার