Top

দেশের বৃহৎ মৎস্য ক্ষেত্র মিরসরাই মুহুরী প্রকল্প

১৬ আগস্ট, ২০২১ ১:৪০ অপরাহ্ণ
দেশের বৃহৎ মৎস্য ক্ষেত্র মিরসরাই মুহুরী প্রকল্প
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি :

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে পূর্বে দৃষ্টিনন্দন পাহাড় আর পশ্চিমে সাগরের প্রাকৃতিক নৈসর্গের মাঝে মুহুরীর চর এলাকায় গড়ে উঠেছে দেশের বৃহত্তম মৎস্য প্রকল্প। প্রকল্পের নাম মুহুরী প্রকল্প। এ প্রকল্পের আয়তন প্রায় ৭ হাজার একর। আর এসব মৎস্য প্রকল্প থেকে উৎপাদিত হয় বছরে প্রায় ৪৯ হাজার মেট্রিকটন মাছ। মুহুরী মৎস্য প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ৭০-৮০ মেট্রিক টনেরও বেশি মাছ দেশের বিভিন্ন বাজারে আমিষের যোগান দিচ্ছে। এ প্রকল্প দেশের অর্থনীতিতে যেমন অসামান্য অবদান রাখছে, তেমনি বদলে দিয়েছে অনেক বেকার যুবকের ভাগ্য। শুন্য থেকে কোটিপতি হয়েছে শতাধিক ব্যক্তি। একেক মৌসুমে এসব মৎস্য প্রকল্প থেকে প্রায় ১ হাজার ১’শ ২৭ কোটি টাকার মাছ বিক্রি করছেন চাষীরা। মিরসরাইয়ে বছরে মাছের চাহিদা প্রায় নয় হাজার টন। মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় উৎপাদিত মাছ নিজ উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে চট্টগ্রামের ৭০ ভাগ মাছের চাহিদা পূরণ করে।

ফেনী নদীর মিরসরাই-সোনাগাজী অংশের উপকূলীয় অঞ্চলকে বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে ১৯৮৪ সালে ৫০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করে সরকার। বাঁধ নির্মাণের ফলে বাঁধের দুই পাশে কয়েক হাজার একর চর জেগে ওঠে। জেগে ওঠা এ চর আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয় স্থানীয় মৎস্যচাষীদের কাছে। ধীরে ধীরে মুহুরী প্রজেক্ট হিসেবে পরিচিত এ এলাকায় গড়ে ওঠে পরিকল্পিত মৎস্য প্রকল্প। কেবল স্থানীয়রাই নয়, সেখানে বিনিয়োগ করে দেশের নামিদামি শিল্প গ্রæপগুলো।

১৯৯৬ সালের শুরুর দিকে স্থানীয় ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাঈনুল ইসলাম, আবুল খায়ের কোম্পানী, বাবুল চৌধুরী, এম.এইচ. লাভলু চৌধুরী আধুনিক পদ্ধতিতে মৎস্য চাষ শুরু করেন। তাদের সফলতার পথ ধরে ধীরে ধীরে এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবকরা চাকুরীর পিছে না ছুটে গড়ে তোলেন শতশত মৎস্য প্রকল্প। বর্তমানে মৎস্য চাষে বিপ্লব ঘটিয়ে দেশের সবচে বড় মৎস্য জোন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে মুহুরী চরের মৎস্য প্রকল্প এলাকা। এখানে বাণিজ্যিকভাবে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় মৎস্য প্রকল্প গড়ে তুলেছে বসুন্ধরা গ্রুপ, মেরিডিয়ান গ্রুপ, ক্লিফটন গ্রুপ, আবুল খায়ের কোম্পানী, মামুন গ্রুপ, সততা ফিস প্রজেক্ট, রিংকু ফিস প্রজেক্টসহ ৫ শতাধিক মৎস্য প্রকল্প।

মুহুরী প্রকল্পে মাছ চাষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন সহস্রাধিক মানুষ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। শুধু তা-ই নয়, মৎস্য উৎপাদন ক্ষেত্র হিসেবে খ্যাত মিরসরাইয়ে রয়েছে ২৯টি জেলে পাড়া। এসব জেলে পাড়ার হাজার হাজার মানুষও মাছ ধরে জীবন ধারণ করে থাকেন।

মৎস্য চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মুহুরী চর থেকে প্রতি বছর সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করলেও এখানকার মৎস্য চাষীরা সরকারী সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। মাছ পরিবহন ও খাদ্য সরবরাহের জন্য অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রধান অন্তরায়। এছাড়া প্রকল্পে পানি সেচ ও নিষ্কাশনের জন্য কোন ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। শুষ্ক মৌসুমে মৎস্য প্রকল্পগুলোতে মিঠা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। মুহুরী সেচ প্রকল্পের উজান থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে মৎস্য প্রকল্পে মিঠা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হলে মৎস্য উৎপাদন তুলনামূলক কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলে মনে করেন চাষীরা। রাস্তার পাশের প্রকল্পগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকলেও চরের ভেতরে অবস্থিত প্রকল্পগুলোতে বিদ্যুতের কোন ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা না থাকায় প্রকল্পে খাদ্য দেওয়া, ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে পানি তোলা সহ আধুনিক প্রযুক্তিতে মৎস্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। মুহুরীর চরের প্রকল্পগুলোর বেশীর জমি খাস খতিয়ানভুক্ত। এসব জমি চর জেগে উঠার পর সরকার ভূমিহীন ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামে বরাদ্ধ দেয়। তাদের থেকে মৎস্য চাষীরা জমিগুলো লিজ নিয়ে দীর্ঘনি ধরে মাছ চাষ করছে। জমির মালিকানা দলিল না থাকায় মৎস্য চাষীরা ব্যাংক ঋণের আবেদন করেও ঋণ পাচ্ছেননা। স্থানীয় মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় সরকারী বা বেসরকারী কোন তফসিলী ব্যাংকের শাখা না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে চাষীরা মোটা অংকের টাকা লেনদেন করছে। এখানে যেকোন সরকারি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা স্থাপন মাছ চাষীদের দীর্ঘদিনের দাবি। বর্তমানে মৎস্য চাষে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলেও এখানকার মৎস্য চাষীদের সরকারী ভাবে কোন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। এছাড়া মাছের বাজার দরপতনের সময় সংরক্ষনের জন্য বরফকল না থাকায় ন্যায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত চাষীরা।

আনোয়ার এগ্রো লিমিটেডের সত্ত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন বলেন, মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় তার ১৩০ একরের মৎস্য প্রকল্প আছে। মাছ চাষীদের টাকা লেনদেনের জন্য ব্যাংক শাখা জরুরী প্রয়োজন। মিরসরাই উপজেলা ও সোনাগাজি উপজেলার বৃহৎ অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর গড়ে উঠছে। যেখানে অনেক মৎস্য প্রকল্প অধিগ্রহনের সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের উচিৎ মৎস্য প্রকল্পের ক্ষতি না করে মাষ্টার প্লান করে পরিকল্পিত ভাবে মৎস্যজোন স্থাপন করা। তবে দিন দিন মাছের খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচের তুলনায় লাভ কম হচ্ছে।

মৎস্য চাষী মো. কামাল উদ্দিন জানান, বিভিন্ন সময় মাছের নতুন নতুন রোগ দেখা দেয়। তখন চাষীদের লক্ষ লক্ষ টাকার মাছ মারা যায়। চাষীরা তখন উপজেলার মৎস্য অফিস থেকে কোন সঠিক পরামর্শ পায়না। চাষীদের এজন্য মহুরী প্রজেক্ট এলাকায় একটি মৎস্য ও হ্যাচারী ল্যাব স্থাপন করা প্রয়োজন।

রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান কিছমত ট্রেডিং এর সত্ত্বাধিকারী কমরুদ্দীন চৌধুরী বলেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মাছ সহ বিভিন্ন কাঁচামাল রপ্তানী করে থাকেন। মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় শুধুমাত্র বরফকল না থাকার কারণে বছরে কোটি কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে স্থানীয় মৎস্য চাষীদের। এখানকার মাছ বাজারজাত করার সময় বরফকল না থাকায় অনেক সময় মাছ পঁচে যায়। ফলে ব্যবসায়ীদের অনেক টাকা লোকসান গুনতে হয়। বরফকল স্থাপন করা হলে এখানকার মাছ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করা যাবে।

মিরসরাই উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদ বলেন, মিরসরাইয়ের মৎস্য চাষীরা তাদের নিজেদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করে থাকেন। যেখানে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুন বেশী মাছ উৎপাদন হয়। আধুনিক প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করার জন্য সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। চট্টগ্রামের ৭০ ভাগ মাছের চাহিদা পূরণ করে মুহুরী প্রজেক্ট মৎস্য প্রকল্প। এখানে যারা মাছ চাষ করেন, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের যেকোনো প্রয়োজনে যথাযথ সহায়তা ও পরামর্শ দেয়া হয়।

শেয়ার