বাড়ির পাশেই প্রকৃতির বহু অপুরুপ সৌন্দর্য লুকানো রয়েছে যা দূরের অনেক ভ্রমণ পিপাসুর দল জানলেও অনেক সময় ঘরের পাশের লোক দেখবে তো দূরে থাক নামই হয়তো কোনদিন শুনে নাই।তেমনি একটি উপজেলা সিতাকুন্ড।যার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে প্রকৃতির সব অপার রহস্য।

মিরসরাই আর সিতাকুন্ড বারেবার ছুটে যাওয়া ভ্রমণ পাগলাদের প্রতি মিষ্টিমধুর টিপ্পনি কেটে হয়তো খোদ সেসব অঞ্চলের মানুষরাই বলে উঠে, ‘কেন যায় তারা সেখানে এতো! কি আছে একই জায়গা এতবার দেখার।’ আর আমি ভ্রমণ পিপাসুদের পক্ষ হতে বলব চট্টগ্রামের সিতাকুন্ড উপজেলার ভূমি, প্রকৃতির এমন একটি দান যেখানে একবার-দুবার নয় অন্তত যেতে হবে পঞ্চাশবার। তাহলে হয়তো সিতাকুন্ডের নানান রুপ কিছুটা হলেও দেখা সম্ভব হতে পারে।

গ্রিষ্ম /বর্ষায় যৌবন খেলে ঝর্ণার।প্রকৃতি মেলে ধরে নিজেকে নতুন রুপে।আর শীতে ঝর্ণা যাওয়ার পথ গুলো হয় সর্ব শ্রেণীর ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য অন্যরকম ভালোলাগার মত মনোমুগ্ধকর হাইকিং-ট্রেইল। সেই রুপের নির্জাস নিতেই বর্ষায় যাওয়া অ্যাডভেঞ্জার প্রিয় পর্যটকদের মত শীতেও ছুটে যান আরেকদল ভ্রমণ প্রিয় মানুষ।জোঁক ও পথের পাথুরে পিচ্ছিলতা না থাকায় এই সময়টায় ট্রেইলের জন্য সর্বদাই মুখিয়ে থাকে পরিবারের ছোট বড় সবাই।

বাণিজ্য প্রতিদিনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

বাংলাদেশের অন্যতম ভ্রমণ সংগঠন “দে-ছুট” ভ্রমণ সংঘ’র বন্ধুরাও ঘুরে বেড়ায় গহীন ঝোপ-জঙ্গলে, লোক চক্ষুর অন্তরালে থাকা প্রকৃতির সন্ধানে। প্রশাসনিক জটিলতায় বান্দরবানের গহীনে যাবার নিষেধাক্কা থাকায় ইদানিং কাছে ধারেই ঘুরে-বেড়াই। সেই ঘুরে-বেড়ানোর মাঝেই অদ্ভুদ আশ্চর্য রকম সৌন্দর্যময় প্রকৃতি চোখে ধরা দেয়। যা ভাবতেও অবাক লাগে যে, এরকম জায়গায় এত সুন্দর মায়াময় প্রকৃতি আপন খেয়ালে সেজে-গুজে রয়েছে।অথচ এর পাশ দিয়ে কত শতবার গিয়েছি পার্বত্য জেলা গুলোতে। গাড়ীর জানালা দিয়ে শুধু মিরসরাই আর সিতাকুন্ডর পাহাড় মালা গুলোই দেখতাম। কিন্তু কখনো ভাবিনি বা ভাবার চেষ্টাও করিনি, এর মাঝেও যে লুকিয়ে থাকতে পারে আশ্চর্য সুন্দর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক রুপ লাবণ্য। কথায় আছে না মক্কার লোক হজ পায় না। ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই। যখন নানান মাধ্যমে খবর পেলাম চট্টগ্রাম জেলার সিতাকুন্ড উপজেলার পন্থিছিলা’র হাজী পাড়া গ্রাম পেরিয়ে এগিয়ে গেলে, পাহাড়ের গভীরে মূর্তি নামক একটি ঝর্ণা রয়েছে।যা সচারচর সাধারণ ভ্রমণ পিপাসুরা ঝরঝরি ট্রেইল হিসেবেই চিনে। কিন্তু মুর্তি ঝর্ণা পর্যন্ত যাওয়া হয় না অনেকেরই।

কিন্তু আমরা যাব বলেই গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে রওনা হই। রাতে রওনা দেয়ার কারণও ছিল। যেন ভোর পাঁচটার মধ্যেই পৌছে যাই। কিন্তু একি হায়! ঢাকা বাসির নিত্য সঙ্গী যানজট এখন মহামারী আকার ধারণ করে আশেপাশের মহাসড়ক গুলোতেও আছড়ে পড়েছে। তাই ভোর পাঁচটা/ছয়টার বদলে প্রায় পাঁচ ঘন্টা লেটে সকাল সাড়ে দশটায় পন্থিছিলা পৌছাই। আগে থেকেই গাইড অপেক্ষায় ছিল। তাই দেরী না করেই রেল লাইনের পাশে গাড়ী পার্ক করেই শ‍ুরু করি হাইকিং। মনে বেশ সংশয়! মিশন পূর্ণ করার পর্যাপ্ত সময় পাব তো?

নানান সবজি বাগানের পাশ কেটে দ্রুত হেঁটে চলছি। একটা সময় মাথার উপর তেজোদিপ্ত সূর্যটাকে পেছনে ফেলে ঢুকে যাই আলো-ছায়া’র জঙ্গলে। এবার পাহাড়, ঝিরিপথে হাইকিং-ট্র্যাকিং চলছে সমান তালে। চারপাশে সবুজ আর সবুজ। যেন সুবুজের চাদরে মোড়ানো পথ দিয়েই হেঁটে চলছি। মাঝে মধ্যে বিশাল বিশাল গাছতলায় বসে জিরিয়ে নেই। চলার পথে ছোট বড় অনেক গুলো ক্যাসকেড পড়ে। ক্যাসকেডের জমানো পানি চোখে-মুখে ছিটিয়ে ক্লান্তি দূর করি। প্রকৃতির মোহে পড়ে ভুলে যাই সময়-জ্ঞান।

নানান হাস্যরস্য আর প্রকৃতিক রুপের পসরা দেখতে দেখতে গিয়ে পৌ‍ঁছাই ঝরঝরি ঝর্ণার সামনে।সাধারণ পর্যটকরা ঝরঝরি ঝর্ণা ঘিরে বেশ জটলা পাকিয়েছে। চলছে বেশ হৈ-হুল্লুর।খুব বেশী উঁচু থেকে নয় তবে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে ঝরঝরির পানি অবিরাম ঝড়ে পড়ছে। পানি পড়ার কারণে সামনে একটা মোটামুটি সাইজের জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানেই আগন্তুক দল জলকেলিতে মেতে উঠে। তবে জায়গাটার প্রাকৃতিক আবহ বেশ চমৎকার! আমরাও সেখানে কিছুক্ষণ বসে নুডলস খেয়ে নেই। এর পর আবারো হাঁটা। মানুষের জটলা কমে আসে। ধীরে ধীরে নৈঃশব্দ আমাদেরকে গিলে ফেলে।

যতই এগিয়ে যাই ততোই মুগ্ধতা ভর করে। কোথাও কোথাও প্রাকৃতিক ভাবেই সিঁড়ি তৈরী হয়েছে। আমরা উপরের দিকেই উঠছি। সত্যিই অনেক সুন্দর নান্দনিক একটা ট্রেইল! এবার সামনে পড়ল খুব সুন্দর একটা খুম। খুম মানে গর্ত।যেখানে পানি জমে থাকে। তবে এই গর্ত কিন্তু সাধারণ কোন গর্ত নয়। বলা যায় পাহাড়ের উপর সুইমিংপুল। স্থীর থাকা খুমের পনি গাড় সবুজ। গাছের পাতা আর পানির রঙ যেন মিলে মিশে একাকার। এক কথায় অসাধরণ সৌন্দর্যের খুম। ফটোসেশন পর্ব শেষে আবারো হাঁটা।

এবার কিছুটা পিচ্ছিল পথে জঙ্গল মাড়িয়ে, লতা-গুল্ম ধরে পাহাড়ের আরেকটু উপরে উঠতে হবে। উঠার সময় বেশ থ্রীল একটা ভাব অনুভূত হল। উঠার পর সাবধানে এগিয়ে চলা। সামান্য পা পিছলে গেলেই সোজা গভীর খুমে। তবে বেশীটা পথ নয়। খুব সামান্য দূর এগুতেই কানে ভেসে এল রিমঝিম শব্দ। চোখে ধরা দিল দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বড় বড় বোল্ডার বিছানো সরু পথ। পাহাড়ের দুপাশ লতা-গুল্ম দিয়ে ঘেরা। আরেকটু আগাতেই নজড়ে এল শুভ্র সাদা ফেনা তোলা আছড়ে পড়া ঝর্ণার পানি। ওয়াও! পেয়ে গেছি। ইতিমধ্যে বড় এক লড়া [বিচ্ছু] আমার বুকে জড়িয়েছে পরম মমতায়। কিন্তু খেয়াল করার সময় কোথায়? বেশী কিছু বুঝার আগেই গাইড ফেলে দিল। পাথরের বোল্ডার টপকিয়ে-খুম পেরিয়ে সোজা গিয়ে বসলাম ঝর্ণার কুলে। আহ্ পরম শান্তি! যে পাথরের কারণে ঝর্ণাটির নাম মূর্তি হয়েছে সেই পাথরের সাথে গাল মিলালাম। প্রাকৃতিক ভাবেই একটি পাথর ঠিক মানুষের মাথা, চোখ, নাক, কপালের আকৃতি ধারণ করে আছে। অনেকটা ছোটবেলায় শোনা ব্ল্যাক ম্যাজিকের কাহিনীর মত।থাক সেসব ভাওতাবাজীর কাহিনী।আমরা ভিজে নেই মন ভরে।ডুব দেই খুমের পানিতে। মূর্তি ঝর্ণাটি খুব বেশী চওড়া নয়। পনিও খুব একটা উঁচু থেকে পড়ে না। তবে গড়িয়ে পড়া পানির ক্ষিপ্রতা বেশ।সব মিলিয়ে চমৎকার এক ভৌতিক বুনো পরিবেশ। দিনে দিনে ঘুরে আসার মত অসাধরণ এক বন-জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি ঝিরি-ঝর্ণার ট্রেইল।

চলুন যাই:- ঢাকা হতে চট্টগ্রামের বাসে বা রেলে চড়ে সিতাকুণ্ডর পন্থিছিলা।সেখান থেকে হাজীপাড়া গ্রামের রেললাইন পার হয়ে কানী ছড়া ধরে এগিয়ে যাবেন। পন্থিছিলা হতে যাওয়া-আসা ও নানা স্থানে বসে জিরিয়ে সব মিলিয়ে সময লাগবে ৬/৭ ঘন্টা।

ভ্রমণ তথ্য:- এখানকার ঝর্ণা গুলোর চাইতে পথের সৌন্দর্যই অসাধারণ! নিরাপদ ট্রেইলের জন্য রেললাইনের পাশে থাকা দোকানীদের সাহায্য নিন। তারাই আপনাকে ভালো গাইডের খোঁজ দিতে পারবে। গাইড ছাড়াও যাওয়া যাবে তবে তা অনেক সময় পথ হারাবার জন্য যথেষ্ট। গাইড চার্জ আপনার খুশীর উপর নির্ভর।

টিপস: অপচনশীল কোন কিছু ফেলবেন না, সাথে চটের ব্যাগ রাখুন, অতি উচ্ছ্বাস যেন বন্য জীবজন্তুর বিরক্তির কারণ না হয়।