Top

এক বিদ্যালয়ের ৮৫ জন ছাত্রীর বাল্যবিবাহ

২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ৫:৪৭ অপরাহ্ণ
এক বিদ্যালয়ের ৮৫ জন ছাত্রীর বাল্যবিবাহ
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি :

দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে এক বিদ্যালয়ে ৮৫ জন ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। বিদ্যালয়ে উপস্থিতি কম হওয়ায় শিক্ষকদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। এসব শিক্ষার্থীরা অপরিনত বয়সেই এখন স্বামীর বাড়ীতে ঘর-সংসার করছে। সচেতন মহলের দাবী- দারিদ্রতা, যোগাযোগ বিচ্ছন্নতাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার জন্য এ উপজেলায় বাল্যবিবাহের হার হু-হু করে বেড়েই চলেছে। কোন ক্রমেই ঠেকানো যাচ্ছে না বাল্যবিবাহ।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছে, জরিপ করে প্রকৃত বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রমে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা নির্ণয় করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

গতকাল সোমবার সকালে উপজেলার বড়ভিটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলে, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মুহা: মতিউর রহমান খন্দকার জানান, বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৩৪৫ জনের মধ্যে ৮৫ জনের বাল্যবিবাহ হয়েছে। এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে বলে তিনি জানান।

বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছেন-৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ২, সপ্তম শ্রেণিতে ১১, অষ্টম শ্রেণিতে ১৭, নবম শ্রেণিতে ২৮, দশম শ্রেণিতে ১৪ ও চলতি বছরের এস এস সি পরীক্ষার্থী ১৩ জন। করোনা মহামারীর কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার আগে এই বিদ্যালয়ে প্রতিদিন গড়ে শিক্ষার্থীর উপস্তিতি ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ হলেও এখন উপস্থিতি হচ্ছেন ৪০-৫০ শতাংশ। ঐ প্রতিষ্ঠানের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী নুপুর, আশামনি, নাছিমা ও আতিকা খাতুনসহ অনেকেই জানান, তারা গত ১২ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয় খোলার প্রথম দিনেই তাদের ১৭ জন বান্ধবীর বিয়ে হওয়ার খবর শুনে তাদের সবার মন খারাপ হয়ে যায়। অনেক দিন পর বিদ্যালয় খোলার আনন্দের চেয়ে মন খারাপের পরিমানই ছিল বেশী।তারাও খুব দুচিন্তায় ভুগছেন।

একই প্রতিষ্ঠানের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমী আক্তার বলেন, অনেক পর স্কুল খুললো, সব বান্ধবীর সঙ্গে মজা করবো, আনন্দ করবো, কি আনন্দ! কিন্তু সেটা আর হলো না। স্কুলে এসে দেখলাম আমার ২৮ জন বান্ধবী স্কুলে আসে নাই। খুবই খুবই মন খারাপ হলো। পরে জানতে পারি আমার ২৮ জন বান্ধবীসহ আমার
স্কুলের ৮৫ থেকে ৯০ জন শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। জানি না আমার ভাগ্যে কি হবে। ঐ প্রতিষ্ঠানের বাল্যবিয়ের শিকার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী বিথী খাতুনের বাবা ভ্যান চালক বাদশা মিয়া বলেন, ‘বাহে আমরা গরীব মানুষ। ভ্যান চালিয়ে জীবন-জীবিকা করি। জানেনতো গরীব মানুষের দোষ বেশি। ভাল একনা আলাপ আসছে তাই মোর মেয়েটা বিয়ে দিছং বাহে।’

একই প্রতিষ্ঠানের বাল্যবিবাহের শিকার নিলুফা ইয়াসমিনের বাবা সাইকেল মেকার বাবলু মিয়া বলেন, ‘দেখতেছেন তো কোন রকম মানুষের সাইকেল ভাল করেই যা পাই তা দিয়েই কোন রকমেই চলে সংসার। দেশে করোনা আসিয়া আমরা খুব কষ্টে ছিলাম। কোন সহযোগীতা পাইনি। দেখতে দেখতে মেয়েটাও বড় হয়ে গেল দুচিন্তার যেন শেষ নেই। তা একনা ভাল সমন্ধ পাওয়ায় আর দেরি করি নাই । সাথে সাথে মেয়েটার বিয়ে দিয়েছি। বাল্যবিয়ে দেওয়াটা আমরা ভুল করেছি।’

এ ব্যাপারে বড়ভিটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুহা: মতিউর রহমান খন্দকার জানান, বিদ্যালয় খোলার পর শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম থাকায় আমরা শিক্ষকরা প্রতিটি শিক্ষার্থীদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে খোঁজ খবর শুরু করেছি। যে সব শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে আমরা তাদের বাড়ীও যাচ্ছি। ঐ সব শিক্ষার্থী যাতে স্কুলে আসে সে ব্যাপারে তাদের অভিভাকদের সচেতন করছি। করোনার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা পড়াশুনা থেকে পিছিয়ে পড়েছিল। এই সুযোগে পরিবার তাদের বাল্যবিবাহ দিয়েছেন। আমরা শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য কাজ করছি।

প্রধান শিক্ষক করোনার আগেই গত দেড় বছরেই তার স্কুলের ২৫ থেকে ৩০ জন্য শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন। কিন্তু করোনা কালে খবর না পাওয়ায় গোপনে তার প্রতিষ্ঠানের ৮৫ জন শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহের শিকার হন।

ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো.খয়বর আলী জানান, করোনার কারণে আমার ইউনিয়নে বাল্যবিবাহ বেড়েছে। আমরা এজন্য পদক্ষেপ নিচ্ছি। প্রশাসনের সহযোগীতায় পাড়ায় মহল্লায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মতবিনিময়সহ সচেতনমূলক প্রচার চালানো হবে।

ফুলবাড়ী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো.আব্দুল হাই জানান, বড়ভিটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বাল্যবিবাহের তথ্যটি পেয়েছি। এ উপজেলায় মোট ৭৩ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। বাল্যবিয়ের প্রতিরোধে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবকদের সাথে মতবিনিময় করে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়াতে শিক্ষকদের নিদের্শ দেয়া হয়েছে।

ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুমন দাস জানান, তিনি বড়ভিটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮৫ জন শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহের বিষয়টি শুনেছেন। বাল্যবিবাহ কিভাবে প্রতিরোধ করা যায় সে বিষয়ে সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন ধরণের প্রচার-প্রচারণার কাজ শুরু করেছি। প্রতিটি ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিকে নিয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছে। সেই সাথে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করার কাজ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

শেয়ার