Top

সাধু-সাধকদের মিলন মেলায় পরিণত করতোয়া নদী

৩০ মার্চ, ২০২২ ৫:০৮ অপরাহ্ণ
সাধু-সাধকদের মিলন মেলায় পরিণত করতোয়া নদী
সাজ্জাদুর রহমান সাজ্জাদ, পঞ্চগড় :

করোনার কারণে দুবছর ধরে বন্ধ থাকার পর এবার আবারও শুরু হয়েছে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ৩দিন ব্যাপী ঐতিহ্যবাহী বোয়ালমারী বারুণী গঙ্গা স্নান। স্নান উপলক্ষে বসেছে মেলা।

বুধবার সকাল থেকে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার একমাত্র স্নান স্থান পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার কাজলদিঘী কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নের করতোয়া নদীর উত্তরমুখী স্রোতে এই স্নান শুরু হয়।

দেহ-মন থেকে পাপ মোচন ও পূণ্যের লক্ষে পঞ্চগড় জেলা ছাড়াও পাশ^বর্তী ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লাখো লাখো শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সী পুন্যার্থীরা এখানে আসেন।

বোয়ালমারী বারুনী গঙ্গা মন্দির কমিটি প্রতিবছর এই স্নানের আয়োজন করেন। কিন্তু গত দুই বছর করোনার কারণে তা বন্ধ ছিল। এবার স্নানের ব্যবস্থা করায় করতোয়ার দুই পাড় লাখো পুন্যার্থীতে ভরে গেছে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে কথিত আছে, যে স্থানে নদীর প্রবাহ সোজা উত্তরমুখী সেই স্থানে স্নান করা পুণ্যের কাজ। করতোয়া নদীর এই স্থানে এসে নদীটি প্রায় ১ কিলোমিটার পর্যন্ত উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়। এখানে চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রিদশী তিথিতে চৈত্র মাসে ৩ দিনব্যাপী পুণ্যস্নান চলে। ধর্মীয় বিধান মতে জীবনে মরনে স্নান হলো হিন্দুদের এক অখন্ড মহামন্ত্র। স্নানের পবিত্র ধারায় দেহ ও মনকে ধন্য করায় এক আত্মিক সাধনা। সকল তীর্থ স্থানই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে সাধনার ধন। হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত এই স্নানে করতোয়া নদীর দু’তীর ঘেঁষে চলছে পূজা অর্চণা। শত শত পূজারী ও নর সুন্দর (নাপিত) স্নান চলাকালীন চুল কাটানো কাজে ব্যস্ত। পবিত্র হওয়ার জন্য অনেকে মাথার চুল বিসর্জন দিচ্ছেন। পূজা-পার্বনের সময় কোশার জলে গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতি, সিন্ধু, গোদাবরী নদ-নদীকে সম্মোহিত হতে বলা হয়। পূজায় ঘট স্থাপনকালে মন্ত্রে উচ্চারিত হয় স্বর্গে, মর্ত্যে ও পাতালে গঙ্গাসহ সকল নদ-নদী, সকল সরোবর, প্রস্রবন ও যেখানে যে তীর্থ আছে সবই এ ঘটে সন্নিহিত হোক। মৃত্যুর পরে যে স্নান কার্য সেখানেও একই মন্ত্র উচ্চারিত হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সংকল্প বাক্য স্নানমন্ত্র পাঠ করে হাতে বেল পাতা ফুল ধান দূর্বা হরীতকী কাঁচা আম, ডাব, কলা ইত্যাদি অর্পনের মাধ্যমে স্নান সম্পন্ন করছে।

বোয়ালমারী বারুণী কালিগঙ্গা মন্দিরের সভাপতি পরেশ চন্দ্র বর্ম্মণ জানান, করোনার কারণে দুই বছর ধরে এই স্নান বন্ধ ছিল। এবার চালু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এবার প্রচুর লোকসমাগম হয়েছে। লাখো লাখো ভক্ত এখানে এসেছে। আসলে এখানে কেউ পাপ মুক্তি, কেউ মঙ্গল কামনা, কেউ বাবা মায়ের স্বর্গ লাভসহ নানান মানতে এখানে আসে। অনেকে চুল বিসর্জন দেয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের স্নান ৩ দিন হলেও এখানে ৭ দিন ব্যাপী মেলার আয়োজন থাকে। তবে মুসলমানদের রমজান উপলক্ষে এবার মেলাও ৩ দিন চলবে। সকল শ্রেণীর মানুষের বিনোদনের জন্য মেলায় নাচ গান, যাত্রা, সার্কাসের ব্যবস্থা রয়েছে। মেলা উপলক্ষে এখানে নিত্য প্রয়োজনীয় নানান জিনিসপত্র বিকিকিনি হয়। পূণ্যস্নান উপলক্ষে মন্দির কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত মেলাটি এবার ১ লাখ ৬৩ হাজার টাকায় ডাক হয়েছে। এবার মেলাটি নিয়েছেন স্থানীয় জহিরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। মেলা উপলক্ষে এখানে প্রায় ছোটবড় দুই হাজারেরও বেশি দোকানপাট বসেছে।

পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলার আলোয়াখোয়া থেকে আসা কালু বর্ম্মন জানান, পরিবারসহ স্নান করতে এসেছি। স্নান করলে পাপ মোচন হয়। করোনার কারণে দুবছর আসা হয়নি। আমরা প্রতিবছর এখানে পুজা অর্চনা ও স্নান করি।

দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়ন থেকে আসা কার্তিক চন্দ্র রায় জানান, প্রয়াত বাবা মা’র আত্মা যেন স্বর্গবাসী হয়, পরিবারের যেন মঙ্গল হয় এজন্য এখানে এসেছি।

নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার কৈমারী ইউনিয়নের জগবন্ধু বর্ম্মণ জানান, উত্তরমুখী স্রোতে বহমান স্থানটি আমাদের ধর্মে একটি পবিত্র স্থান। পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বোয়ালমারীর করতোয়া নদীর প্রায় এক কিলোমিটার এলাকার স্রোত উত্তরমুখী হওয়ায় এখানে অনেক দূরদুরান্তের সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এখানে আসেন। কেউ চুল বিসর্জন দেন, কেউ মানত করেন, আবার কেউ নিজের পরিবারের ও দেশের মঙ্গল কামনায় পুজা অর্চনা করেন।

পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী জানান, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তিন দিনব্যাপী স্নানে যাতে কোন প্রকার আইন শৃংঙ্খলার অবনতি না ঘটে এজন্য আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের টহল টিমও এসব কার্যক্রম মনিটরিং করছেন।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম জানান, শান্তিপূর্ণভাবে সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বীরা পূণ্য স্নান করছেন। স্নানকে ঘিরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। আইন শৃংখলার যাতে বিঘ্ন না ঘটে এজন্য আনসার পুলিশও মোতায়েন করা হয়েছে।

শেয়ার